‘৮৩’ আসলে টাইম মেশিন, স্বপ্ন সত্যি হওয়ার গল্পকে ফুটিয়েছেন পরিচালক কবীর খান, অনবদ্য রণবীর
৮৩ সিনেমার মুভি রিভিউ
যে দেশে ক্রিকেটকে ধর্ম হিসাবে দেখা হয়, সেখানে বলিউডের মেইনস্ট্রিম সিনেমায় উঠে আসল ১৯৮৩ সালে ভারতের বিশ্বকাপ জেতার ঐতিহাসিক গল্প, যা ভারতীয়দের কোনও স্বপ্নপূরণের চেয়ে কম ছিল না। পরিচালক কবীর খানের '৮৩’ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জই ছিল, শুধু পরিচালক হিসাবেই নয়, বরং এই সিনেমার মুখ্য অভিনেতা রণবীর সিং, যিনি কিংবদন্তী ক্রিকেটার কপিল দেবের জুতোয় পা গলিয়েছেন, তাঁকে নিয়েও। তবে সিনেমাটি দেখার পর এটা বলাই যায় যে কবীর খান সফল হয়েছেন। আর রণবীরর সিং অনবদ্য কপিল দেবের চরিত্রে।
সিনেমার গল্প সকলেরই জানা
এই সিনেমার পটচিত্র নিয়ে নতুন করে পরিচয় করানোর কোনও প্রয়োজন যদিও নেই। এটি এমন একটি সিনেমা যা ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বিজয়ের বর্ণনা দেয়। যদিও এই বিশ্বকাপের গ্র্যান্ড ফাইনাল লেখা রয়েছে ইতিহাসের পাতায়, তাও এই সিনেমা কথা বলবে ভারতীয় দলের গোপন রত্ন ও খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত উপাখ্যান নিয়ে। ১৯৮৩ সালের ২৫ জুন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ফাইনাল খেলা ভারতীয় দলের পুরো দলকে চিত্রিত করা হয়েছে এই সিনেমায়। ক্রিকেটের ইতিহাসে এই তারিখ সর্বদা জ্বলজ্বল করবে।
রণবীর সিংকে কপিল দেব হয়ে উঠতে অন্যান্যদের সহায়তা
ক্যাপ্টেন হিসাবে রণবীর সিং নেতৃত্ব দিলেও, তাঁকে অসামন্য সমর্থন করেছেন সিনেমার অন্যান্য অভিনেতারাও, যাঁদের অসাধারণ পারফর্ম দর্শককে অবশ্যই মুগ্ধ করবে। সিনেমায় প্রত্যেক অভিনেতাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, যা খুব সুন্দরভাবে চূড়ান্ত মুহূর্তে যোগ হয়েছে। সেটা কপিলের কোচ পিআর মান সিং-এর (পঙ্কজ ত্রিপাঠি) সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হোক বা কপিল দেবের সুনীল গাভাস্করের (তাহির রাজ ভাসিন) সঙ্গে টেনশনের মুহূর্ত হোক, প্রত্যেক দৃশ্য এতটাই জীবন্ত ছিল যে মনে হতেই পারে আপনি স্বচক্ষে ৮৩' সালের বিশ্বকাপ জয়ের দিকে এগোনো ভারতীয় দলের সফর দেখছেন। ক্রিকেট পিচে প্রতিটি খেলোয়াড়ের চোখে উদ্বেগ ও ব্যাটিং-এর দৃশ্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ মুহূর্তে চলে যাবেন
কবীর খান প্রতিটি খেলোয়াড়কে আবেগ দিয়ে রঙ করেছেন এবং কপিল দেবকে পরিপূর্ণ দল থেকে একটু আলাদা করে তুলে ধরেছেন। যিনি জানতেন যে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের (জিভা) হাস্যরস দুর্দান্ত বা বলবিন্দর সাধুর (অ্যামি ভির্ক) বড় ম্যাচের আগে ব্যক্তিগত ক্ষতি হয়েছে। ছোট ছোট এই মুহূর্তগুলি '৮৩'-কে দারুণভাবে সুন্দর ও বার বার দেখার যোগ্য বানিয়েছে। দর্শকরা জানেন ক্লাইম্যাক্স কি হতে চলেছে এবং শেষ দৃশ্য কি হবে। তা সত্ত্বেও ভারতীয় দলের মারা প্রত্যেক বাউন্ডারি ও ছক্কায় আপনি হাততালি না দিয়ে থাকতে পারবেন না। মনে হবে যেন সত্যি বিশ্বকাপের ময়দানে রয়েছেন। এই সিনেমার একটি দৃশ্য, যেখানে কপিল দেব ও মহিন্দর অমরনাথ (সাকিব সালীম)-এর মধ্যে কোনও সংলাপ না থাকলেও, তাঁদের একে-অপরের চোখের ভাষা বিনিময়, যার মধ্য দিয়ে দুই অভিনেতা নিজেদের আবেগ ও অনুভূতি বোঝাচ্ছেন, তা কোনও শব্দ হয়ত প্রকাশ করতে পারবে না। আর এটাই সিনেমার জোরদার ও পক্ত চিত্রনাট্যের ক্ষমতা। পরিচালক কবীর খান নির্মিত '৮৩' ছবিটি নিজের মধ্যেই এই কটূক্তি এবং জেতার জেদকে তুলে ধরেছে, যা পর্দায় দৃশ্যমান।
কবীর খানের সফলতা
পরিচালক ক্রিকেটিং শট, রিলের চমৎকার ব্যবহার এবং বাস্তব ফুটেজ, ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড়দের বিশেষ করে ভিভিয়ান রিচার্ডস দেখানোর জন্য কোন কসুর রাখেননি। যা ক্রিকেট ভক্তদেরও সান্ত্বনা দেয়। এর বাইরে ইংরেজি সংবাদপত্রে লেখালেখি, কপিল-গাভাস্কারের ঝগড়া, বিবিসি ধর্মঘটসহ অনেক কিছু অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অনবদ্য অভিনয়
এই সিনেমায় রণবীর সিং এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যাঁকে ভারতীয় ক্রিকেটে জীবন্ত কিংবদন্তী হিসাবে মনে করা হয়। কিন্তু রণবীরের সেই আত্মবিশ্বাস ছিল। কপিল দেবকে একেবারে নিজের মধ্যে বসিয়ে নিয়েছিলেন রণবীর। তাঁর অভিনয় নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না। আর এই সিনেমা তাঁকে কেরিয়ারের সেরা অভিনয় করার সুযোগ করে দিয়েছে। কপিল দেবের স্ত্রী রোমির ভূমিকায় দেখা গিয়েছে রণবীরের রিয়্যাল লাইফের স্ত্রী দীপিকা পাড়ুকোনকে। তিনিও অসামান্য অভিনয় করেছেন, যিনি কপিল দেবের পাশে তাঁর শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রণবীর ও দীপিকাকে বড় পর্দায় একসঙ্গে অনেকদিন পর দেখা গেল, যা এই সিনেমার আরও একটি ইউএসপি। রণবীরের পর আবারও সেরা কাজ পঙ্কজ ত্রিপাঠীর। পিআর মান সিং এই ছবিটি এবং দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সুতো, যা ক্রিকেট মাঠ এবং ড্রেসিংরুমের মধ্যে দূরত্ব কমিয়েছেন। পঙ্কজ ত্রিপাঠীর টাইমিং, ঘাড় নড়াচড়া আর চোখ আবার জাদু করল। ফিল্ম এবং বিশ্বকাপে পিআর মান সিংয়ের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটি থেকে বোঝা যায় যে গল্পের শুরু এবং শেষ উভয়ই পিআর মান সিং করেছেন।
৮৩ আপনাকে আবেগপ্রবণ করে তুলবে
২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের ছবিতে এত বড় একটা জিনিস কীভাবে আনা যায় সেটাই ছিল পরিচালক বা লেখকের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রতি মিনিটে আপনি একটি উপাখ্যান দেখেন, টিম ইন্ডিয়া নির্বাচন থেকে বিশ্বকাপ জেতা পর্যন্ত, প্রতিটি মুহূর্ত একটি গল্প। টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়ক কপিল দেব থেকে শুরু করে ম্যানেজার পিআর মান সিং, তাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই সিনেমার অভিজ্ঞতা আপনাকে আবেগঘন করে তুলবে। কারণ এখানে ক্রিকেট, বলিউড আর দেশপ্রেম সবকিছুই আছে, যার মশলা পর্দায় এলে হাসায় আর কাঁদায়। ফিল্মটি দেখার সময় আপনার ক্রিকেট ভক্ত সত্ত্বা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হবে।