রোমান্স আর রোমাঞ্চে ভরা এক 'স্টার', অস্তমিত হল 'শশী'
ভারতের প্রথম ক্রস-ওভার স্টার বলা হয় তাঁকে। কারণ, শশী কাপুরের আগে কেউ ভারতে থেকে আন্তর্জাতিক সিনেমা বানানোর মতো অ্য়াডভেঞ্চারে নামার সাহস দেখাননি।
'স্টার'! এই একটা শব্দই তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। অর্থ কামানোর নেশা নয় শুধুই অভিনয়। ওটাই তাঁর কাছে প্য়াশন,ধর্ম আর স্বপ্ন। আর এ জন্য তিনি সবকিছু ত্যাগ করতে পারেন। তাঁর কাছে কুছ পরোয়া নেই কার-ছেলে, কার বংশের উত্তারাধিকারি-এমন সব তকমার। সেই কারণে অনায়াসে নিশ্চিত জীবন ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন অজানার জন্য। এই জন্যই তাঁর নাম বলবীর রাজ কাপুর। যাকে তামাম দুনিয়া চেনে শশী কাপুর নামে।
ভারতের প্রথম ক্রস-ওভার স্টার বলা হয় তাঁকে। কারণ, শশী কাপুরের আগে কেউ ভারতে থেকে আন্তর্জাতিক সিনেমা বানানোর মতো অ্য়াডভেঞ্চারে নামার সাহস দেখাননি। ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে কলকাতার বুকে জন্ম। আর এই কলকাতার বুকেই থিয়েটারে-থিয়েটারে কাজ করে শরীরের মজ্জা থেকে মনের ইঞ্চি- ইঞ্চিকে ডুবিয়ে নিয়েছিলেন অভিনয়ের আলোয়।
পৃথ্বিরাজ কাপুরের ছেলে, রাজ কাপুর, শাম্মী কাপুরের ভাই। তবু পাঁচের দশকে এক অনিশ্চিত জীবনের মধ্যেই পড়েছিলেন শশী কাপুর। বলতে গেলে পৃথ্বিরাজ কাপুরের অভিনেতা ছোট ছেলের মধ্যে সকলে এক বোহেমিয়ানার ছায়া যেন খুঁজে পেতেন। আসলে অভিনয়ের রাগ-উৎস সন্ধানে শশী তখন ছুঁটে বেড়াচ্ছেন। এমনই এক সময়ে কলকাতার বুকেই পরিচয় ব্রিটিশ অভিনেত্রী জেনিফার কেন্ডালের সঙ্গে। 'শেক্সপিয়ারিয়ানা' নাট্য দল নিয়ে জিওফ্রে কেন্ডাল তখন কলকাতায়। এই দলেই লিড-অ্যাক্ট্রেস ছিলেন জিওফ্রে-র বড় কন্যা জেনিফার। শশী কাপুরও নাম লেখালেন 'শেক্সপিয়ারিয়ানা'-য়।
জিওফ্রে কন্য়া জেনিফারের সঙ্গে শশীর 'লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট' শুরু হতে অবশ্য দেরি হয়নি। বয়সে বড় হলেও জেনিফার তখন এই কলকাতার বুকেই হৃদয় দিয়ে ফেলেছিলেন বিদেশি লুকের শশী কাপুরকে। স্টেজ অভিনয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎও বাধা হতে পারেনি এই প্রেমে। কয়েক বছর আগে শেষবার যখন কলকাতায় এসেছিলেন শশী কাপুর তখনও বারবার স্মরণ করেছিলেন তাঁর ও জেনিফার সেই প্রেমের দিনগুলিকে। মধ্য কলকাতার এক হোটেল, তার টেবিলের উপর জ্বলতে থাকা মোমবাতির আলো। আর তার পাশে বসে থাকা জেনিফার। এই ছবি যেন বারবার ফিরে আসত তাঁর স্বপ্নে।
তাঁর-জেনিফারের সংসারে অভাব একটা সময় এতটাই বড় থাবা বসিয়েছিল যে নিজের সাধের স্পোর্টস কারটাও বিক্রি করে দিয়েছিলেন শশী। এমনকী জেনিফারও তাঁর গয়না-গাটিও বিক্রি করে দিয়েছিলেন। শশী তখন কাট- বেকার যাকে বলে। জেনিফার তখন এক সন্তানের মা।
ওস্তাদের মার শেষরাতে বলে একটা কথা বাংলায় প্রচলিত আছে । ঠিক তেমনভাবেই ১৯৬১ সালের এমনই সময় বলিউডের মঞ্চে আবির্ভাব ঘটল শশী কাপুরের। সে সময় হিন্দি ফিল্মের এক নম্বর নায়িকা নন্দা। তিনি সেই সময় আটটি ছবিতে শশী কাপুরের বিপরীতে সই করেছিলেন। এই জুটির প্রথম ছবি ছিল 'চার দিওয়ারি'। ১৯৬১ সালে মুক্তি পেয়েছিল ছবিটি। পরবর্তীকালে নন্দা জানিয়েছিলেন, তাঁর স্থীর বিশ্বাস ছিল শশী ভারতীয় চলচ্চিত্র-কে কিছু দিতে এসেছেন। তাই শশী-র সঙ্গে এতগুলি ছবি করতে একবারও তাঁর হাত কাঁপেনি। নন্দা তাঁর জীবনের সেরা নায়ক হিসাবেই শশী কাপুরকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আর শশী কাপুরও তাঁর জীবনের সেরা নায়িকা হিসাবে নন্দাকেই স্থান দিয়ে এসেছেন।
১৯৭১ সাল, মুক্তি পেয়িছিল 'শর্মিলি'। শশীর বিপরীতে রাখি গুলজার। গান থেকে ছবির কাহিনি, অভিনয় সে বছর হিন্দি ফিল্মের বক্স অফিসে ঝাঁকিয়ে বসেছিল 'শর্মিলি'। সে সময় প্রায় তিন কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল ছবিটি। এই ছবির মধ্যে দিয়ে অভিনেতা হিসাবে নিজেকে 'স্টার' পর্যায়ে উন্নিত করেছিলেন শশী কাপুর। এরপর ফিল্মি কেরিয়ারে আর তাঁকে কখনও ঘুরে তাকাতে হয়নি। শশী কাপুর মানে তখন হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে আলাদা একটা স্টাইল স্টেটমেন্ট। নাচে-গানে-রোমান্সে এক ভরপুর মশালা হিরো। মারদাঙ্গার সিন হোক বা চূড়ান্ত আবেগে ভরা কোন ডায়লগ-- শশীর তখন জয়জয়াকার। ঝুলিতে তখন সব বড় বড় প্রজেক্ট। এভাবেই 'দিওয়ার' থেকে শুরু করে 'কভি কভি', 'ফকিরা' 'সত্যম শিবম সুন্দরম', 'সুহাগ', 'শান'-এর মতো ছবি। 'দিওয়ার'-এ তাঁর বলা 'মেরে পাস মা হ্যায়' ডায়লগ তো আজ অমর হয়ে গিয়েছে।
অভিনয়ের রাগ-উৎসের খোঁজে এককালে যে বোহেমিয়ানাকে সঙ্গী করেছিলেন শশী, সেখানে পাকাপাকিভাবে ফিরে না গেলেও শরীর জুড়ে সেই অনুভূতিকে যেন বহন করতেন তিনি। তাই বলিউডে হিন্দি কমার্শিয়াল ছবিতে পা রেখেও ১৯৬৫ সালে তিনি অভিনয় করেছিলেন 'শেক্সপিয়ারওয়ালা'-য়। বক্স অফিসে তেমন জমেনি ছবিটি। ১৯৭০ ফের একবার সাহস দেখালেন শশী। স্ত্রী জেনিফারের বিপরীতে করলেন 'বম্বে টকি'। প্রচুর পরিমাণে ক্রিটিক্যাল অ্যাকক্লেমেশন পেয়েছিল সেই ছবি। জেনিফারের অভিনয় প্রতিভা মুগ্ধ করেছিল তামাম ফিল্মি বোদ্ধাদের। কিন্তু, বক্স অফিসে লক্ষ্মীর ভাড়ারে সে ভাবে কিছু জমা পড়েনি।
অভিনয়ের রোমাঞ্চ যাঁর রক্তে সে কীভাবে স্থীর থাকতে পারেন। ভারতে বসে আন্তর্জাতিক সিনেমা বানানোর স্বপ্নে বিভোর শশী খুলে ফেলেছিলেন একটা প্রোডাকশন হাউস। এর জন্য বিদেশ থেকে তাঁকে আমদানি করতে হয়েছিল অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। শ্যাম বেনেগালের মতো পরিচালক শশীর এই ফিল্ম তৈরির কারখানাতেই নিজেকে তৈরি করেছিলেন। এমনকী খোদ সত্যজিৎ রায়-এর প্রধান সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত রায়ও নানাভাবে সাহায্য নিয়েছেন শশীর প্রোডাকশন হাউসের। এমনকী পরিচালক হিসাবে অপর্না সেনের প্রথম ছবি '৩৬ চৌরঙ্গী লেন'-এর প্রযোজক সংস্থা ছিল শশী কাপুরের প্রোডাকশন হাউস।
তবে, শশী কাপুরের ফিল্মি কেরিয়ারের শেষ দিকে হওয়া 'নিউ দিল্লি টাইমস' তাঁর অভিনয় দক্ষতাকে নতুন করে সকলের সামনে হাজির করেছিল। ১৯৮৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা অভিনেতার সম্মান পেয়েছিলেন এই ছবিটির জন্য। অভিনয় কেরিয়ারে পেয়েছেন একাধিক সম্মান। পেয়েছেন পদ্মভূষণ, দাদা সাহেব ফালকে সম্মান। কিন্তু, এই সব পুরস্কার আর সম্মানের ভীড়ে শশী কাপুরকে বাঁধতে যাওয়াটা ভুল। কারণ, শশী কাপুর ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম সেই অভিনেতা যিনি বিশ্বের দরবারে এদেশের সিনেমাকে তুলে ধরেছিলেন। যারই উত্তরাধিকার এখন বহন হচ্ছে একাধিক ভারতীয় অভিনেতার আন্তর্জাতিক সব প্রোডাকশানে কাজ করার মধ্যে দিয়ে।
এহেন শশীর প্রয়াণ স্বাভাবিকভাবে শোকস্তব্ধ করেছে ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতকে। তবে মুম্বই-এর পাশাপাশি কলকাতাও আজ প্রবলভাবে শোকে মূহ্যমান। কারণ, মুম্বইয়ের সঙ্গে কলকাতার ফিল্মি গাঁটছাড়ার সম্পর্কের আরও এক কুশীলব যে চলে গেলেন। যিনি কলকাতাকে কখনও তাঁর হৃদয়ের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেননি। 'আফটার অল' কলকাতাই যে তাঁর ও জেনিফারের যোগসূত্রের 'তাজমহল'।