‘মানসপুত্র’ সৌমিত্রকে নিজের হাতে গড়েছিলেন সত্যজিৎ রায়
সত্যজিৎ রায়ের প্রথম পছন্দ ছিলেন সৌমিত্র
উৎসব মরশুমে চারদিকে যখন এত আলোর রোশনাই, ঠিক তখনই একরাশ বিষন্নতা রেখে চলে গেলেন কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একটা যুগের অবসান হল তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। নিজের জীবনের সেরা অভিনয়র মাধ্যমে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন সৌমিত্র। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই বাংলা সিনেমায় 'অপু’ হয়ে প্রবেশ করে কবে যে তিনি বাঙালির ঘরের ছেলে হয়ে উঠলেন তা নিজেও বুঝতে পারেননি।
সত্যজিত রায় মনোনীত করে রেখেছিলেন সৌমিত্রকে
সত্যজিৎ রায় ‘অপরাজিত'-এর জন্য নতুন মুখ খুঁজছিলেন। কিন্তু ২০ বছরের যুবক সৌমিত্র এই ছবির চরিত্রের জন্য একটু বড় ছিলেন। কিন্তু সৌমিত্রকে এক ঝলক দেখার পরই পরিচালক তাঁকে ‘অপুর সংসার'-এর জন্য অপু হিসাবে মনে মনে মনোনীত করে রেখেছিলেন।
আদরের ছিলেন সৌমিত্র
এরপর ১৯৫৯ সালে ‘অপুর সংসার' ছবির মধ্য দিয়ে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে সৌমিত্রর। এই ছবিতে সৌমিত্রর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। তাঁরও এই ছবির মাধ্যমেই অভিনয় জগতে হাতেখড়ি। এরপর এই পরিচালকের ১৪টি ছবিতে অভিনয় করেন সৌমিত্র। সত্যজিতের বড় আদরের ছিলেন এই ‘অপু'।
সত্যজিৎ–সৌমিত্র জুটি
এর পরের ছবি ছিল ‘দেবী' (১৯৬০)। সৌমিত্র-শর্মিলা এই জুটিকে সত্যজিৎ ফের ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর এই ছবিতে। এর ঘরোয়া গৃহিনীর দেবী হয়ে ওঠার গল্প, যেখানে সৌমিত্র তাঁর স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আসলে পরিচালক জানতেন এই সৌমিত্রর মধ্যে রয়েছে এক সুপ্ত প্রতিভা। এরপর তিনকন্যা (সমাপ্তি), অভিযান, চারুলতা, কাপুরুষ, অরণ্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেত, ঘরে বাইরে একের পর এক ছবিতে অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা দেখিয়ে গিয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিৎ রায় যেন সৌমিত্রকে ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। সত্যজিতের ছেলে সন্দীপ রায় জানিয়েছিলেন যে তাঁদের দু'জনের মধ্যে এক অপত্য স্নেহ গড়ে উঠেছিল। সত্যজিৎ রায় নিজের হাতে গড়েছিলেন তাঁর অপুর সংসারের অপুকে বা চারুলতার অমলকে। তবে সৌমিত্র ছিলেন দারুণ প্রতিভার মানুষ।
মানসপুত্র সৌমিত্র
সৌমিত্র পরিচালকের ২৭ট ছবির মধ্যে ১৪টি ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তাঁর অভিনয়ের পাশাপাশি চিত্রনাট্যের চরিত্রকে নিজের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারটা মুগ্ধ করেছিল সত্যজিৎ রায়কে। আর তাই হয়ত তিনি অন্য কোনও নায়ককে তাঁর ছবিতে নেওয়া পছন্দ করতেন না। অনেকেই সৌমিত্রকে সত্যজিতের ‘মানসপুত্র' বলে থাকেন। আর কথাটা ঠিকই। পরিচালকের চেয়েও সৌমিত্রকে স্নেহ করতেন পুত্রের মতোই। ‘হিরক রাজার দেশে' উদয়ন পণ্ডিত আজও দর্শকদের মনে গেঁথে রয়েছে, গেঁথে রয়েছে তাঁর প্রত্যেকটি সংলাপ।
ফেলুদা চরিত্রে অসাধারণ সৌমিত্র
সত্যজিৎ যখন নিজের সৃষ্ট চরিত্র ফেলুদা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছেন, তখনও কিন্তু তাঁর চিন্তনে সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রয়েছেন। জয় বাবা ফেলুনাথ হোক বা সোনার কেল্লা, ফেলুদা চরিত্রে তিনি যে যথাযথ সেটা প্রমাণ করলেন অভিনেতা। আর তাই এতবছর পরও এই ছবিগুলি এখনও চিরস্মরনীয়। ফেলুদা চরিত্রে এরপর অন্যান্য অভিনেতাদের দেখলেও, সত্যজিতের ফেলুদা বলতে সৌমিত্র রায়ের কথাই প্রথম মনে আসে। ফেলুদা সিরিজের অন্য গল্পগুলি পড়ার সময়ও আমাদের মনের কোণে কিন্তু ভেসে ওঠে সেই তাঁর ছবি। সত্যজিৎ রায় বুঝেছিলেন এই ছেলে একদিন অপু, ফেলুদা হয়ে সকলের মনে ছাপ ফেলে যাবেন, আর তাই তিনি সৌমিত্র ছাড়া কিছুই বুঝতেন না।
সৌমিত্রর প্রয়াণে পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে নুসরত-দেব-মিমির টুইটবার্তায় শোক প্রকাশ