অপু থেকে ক্ষিদ্দা অথবা ময়ূরবাহন থেকে বিশ্বনাথ মজুমদার, সবেতেই সাবলীল ছিলেন সৌমিত্র
অপু থেকে ক্ষিদ দা অথবা ময়ূরবিহার থেকে বিশ্বনাথ মজুমদার, সবেতেই সাবলীল ছিলেন সৌমিত্র
শেষরক্ষা আর হল না। চল্লিশ দিনের লড়াই শেষ করে বাঙালির ঘরের ছেলে 'অপু’ চিরবিদায় নিলেন। রবিবার দুপুর সওয়া বারোটায় কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে চিরনিদ্রায় চলে গেলেন কিংবদন্তী অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সেপ্টেম্বরেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। কিছুদিন ধরেই তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। চিকিৎসায় সাড়া দেওয়াও বন্ধ করে দেন তিনি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে।
প্রথম ছবি ‘অপুর সংসার’
‘অপুর সংসার' থেকে ‘বেলাশেষ'। সফরটা অনেক লম্বা ছিল। কিন্তু এই লম্বা সফরের সময়ও তিনি তাঁর অসাধারণ অভিনয় দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি এক এবং অদ্বিতীয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায় ২০ বছরের এই প্রতিভাটিকে খুঁজে বের করেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সৌমিত্র প্রথম কাজ করেন ‘অপুর সংসার'-এ। এরপর সৌমিত্রকে এই একই পরিচালকের ১৪টি সিনেমায় অভিনয় করতে দেখা যায়। এর পাশাপাশি সৌমিত্রকে দেখা গিয়েছে পরিচালক তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ', ‘ঝিন্দের বন্দি', ‘হাটে বাজারে', ‘হুইল চেয়ার'-এ। ১৯৬১ সালে তুন সিংহের ‘ঝিন্দের বন্দি' সৌমিত্রর অভিনয় জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ‘ঝিন্দের বন্দি' ছবিতে উত্তম কুমারের পাশাপাশি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ময়ূরবাহন চরিত্রে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। শোনা যায়, মহানায়কের চেয়েও সৌমিত্র বেশি প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন।
আলাদা ব্যক্তিত্বের ছিলেন সৌমিত্র
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজস্ব একটা ক্যারিশমা ছিল। ছবিতে তাঁর সিগারেট খাওয়ার ভঙ্গিমা অথবা নায়িকার সঙ্গে রোম্যান্স সবেতেই তাঁর নিজস্ব ছাপ রয়েছে। পরিচালক আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি ‘তিন ভুবনের পারে'-তে তনুজার সঙ্গে জুটি বেঁধে রোম্যান্টিক গান ‘হয়ত তোমারি জন্য' এখনও নতুন প্রজন্মকে মাতিয়ে তোলে। অন্যদিকে তরুণ মজুমদারের ‘গণদেবতা' ছবিতে। এখানে সৌমিত্র দেবু পণ্ডিতের ভূমিকায় যথার্থ অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘গণশক্তি' ছবিতে ডাঃ অশোক গুপ্ত, যিনি সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন, অথবা ‘শাখা-প্রশাখা', যেখানে বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলের মাথা খারাপ হলেও তিনি ভালো-মন্দের বিচার করতে জানেন, বৃদ্ধ বাবার যে একমাত্র অবলম্বন এবং সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত। সব চরিত্রের ছাঁচেই তিনি নিজেকে ঢেলে নিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন।
সেরা ছবি ‘কোনি’
সত্যজিতের ‘অপু' বাঙালির আপামর দর্শকদের কাছে স্মরণ হয়ে রয়েছেন ‘ক্ষিদদার' জন্য। ১৯৮৬ সালে সরোজ দে পরিচালিত এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত একটি জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি ‘কোনি'। এখানে সৌমিত্রর চরিত্রের নাম ছিল ‘ক্ষিদদা'। ২০১২ সালের এক সাক্ষাৎকারে, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘কোনি' চলচ্চিত্রটিকে তার কর্মজীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসাবে অভিহিত করেন। এমনকি তিনি তার বার্ধক্যজনিত অবসাদ কাটিয়ে উঠতে অনেক প্রতিকূল অবস্থায় এই সিনেমার ‘ফাইট-কোনি-ফাইট' কথাটি উচ্চারণ করতেন। কথাটি সেই সময় মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। ক্ষিদদা হিসাবে সৌমিত্র যেন সকলের মনের মাঝে আজও বিরাজ করে রয়েছেন।
সৌমিত্রকে ভেবেই চিত্রনাট্য লেখা
তাঁর অভিনীত বহু ছবি দেখে মনে হত তাঁকে ভেবেই বোধহয় চিত্রনাট্যগুলি লেখা হত। বিজয় বসুর ‘বাঘিনী' ছবিতে চিরঞ্জীব হোক অথবা ‘স্ত্রী' ছবির সীতাপতি, অথবা ‘শ্যাম সাহেব' ছবির চরিত্র, সব ছবি যেন সৌমিত্রকে ভেবেই লেখা হয়েছে। অর্পণা সেনের ‘পারমিতার একদিন' ছবিতে খুব ছোট্ট ভূমিকাতেই দেখা গিয়েছিল সৌমিত্রকে। কিন্তু ওইটুকু চরিত্র যেন তাঁর জন্যই তৈরি করা। জীবনের আড়াইশোটি ছবিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। মনে থেকে যায় ‘সাত পাকে বাঁধা', ‘ক্ষুধিত পাষাণ', ‘ঝিন্দের বন্দি', ‘একটি জীবন', ‘কোনি', ‘হীরক রাজার দেশে', ‘দত্তা অথবা হালফিলের ‘ময়ূরাক্ষী', ‘বেলাশেষে', ‘সাঁঝবাতি'। ছবিতে তিনি তাঁর প্রত্যেকটি নায়িকার সঙ্গে তাঁর মতো করেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করাতেন। অপর্ণা-সৌমিত্র বা তনুজা-সৌমিত্র জুটি আজও বহু মানুষের হৃদয়ে ঝড় তোলে।
‘বেলাশেষে’ যেন এক আলাদা সৌমিত্র
শিবপ্রসাদ ও নন্দিতা রায় পরিচালিত ‘বেলাশেষে' ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একদম আলাদা চরিত্রে অভিনয় করেন। যেখানে তিনি বৃদ্ধ বয়সে নিজের স্ত্রীর থেকে বিচ্ছেদ চেয়ে বসেন। এক প্রবীণ ব্যক্তি তাঁর স্ত্রীয়ের কাছে নিজের জীবনের চাহিদাগুলো তুলে ধরেন, যেখানে তাঁর স্ত্রী সঙ্গে ছিলেন না। তিনি তাঁর প্রতিটি চরিত্রের মধ্য দিয়েই বাস্তব জীবনকে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন আর তাই হয়ত তাঁর চবিত্র জীবন্ত হয়ে উঠত। একই পরিচালকের ছবি ‘প্রাক্তন'-এ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের গুরু গম্ভীর গলায় ‘আমাদের গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে' এখনও শ্রোতাদের কানে বেজে চলেছে।
শেষ ছবি ‘অভিযান’
মহানায়ক উত্তমকুমারের সমকালীন হয়েও নিজের আলাদা পরিচিতি গড়ে তুলেছিলেন সৌমিত্র। তা অবশ্যই নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়েই। মৃত্যুর আগে নিজের জীবন নির্ভর ছবি ‘অভিযান'-এর শুটিং শেষ করেছিলেন। কিন্তু ছবির পরিণাম দেখার আগেই চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। তবে শিল্পী বেঁচে থাকেন নিজের কীর্তির মধ্য দিয়ে। তেমনিই সৌমিত্র বেঁচে থাকবেন আমাদের সকলের মধ্যে।
'শেষ লড়াইটা হেরেই গেলেন, সহযোদ্ধাকে হারালাম', ভাঙা গলায় বললেন সৌমিত্র-কন্যা পৌলমী
{document1}