ফিরে দেখা ২০২০: সুশান্ত সিং রাজপুত! একটা মৃত্যু কাঁপিয়ে দিয়েছে বলিউডকে
২০২০ সাল গোটা বিশ্বকে অনেক অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটনার সাক্ষী থাকিয়েছে। যার মধ্যে প্রধান হল করোনা ভাইরাস সংক্রমণ, যার জেরে দীর্ঘ কয়েকমাস বিশ্ব অচলাবস্থায় চলে যায়। মারণ ভাইরাসের পাশাপাশি দেশের হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এমন একটি ঘটনা ঘটে গেল যা বলিউডের শিকড়কে পর্যন্ত নাড়িয়ে দিল। জুনের ১৪ তারিখ মুম্বইয়ে বান্দ্রার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় বলিউডের প্রতিভাবান অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের ঝুলন্ত দেহ। আকস্মিক এই ঘটনা সামনে আসতেই বিস্মিত ও শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে গোটা দেশ ও সোশ্যাল মিডিয়া।

সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যা
১৪ জুন সকালে মুম্বইয়ে বান্দ্রার ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হয় ৩৪ বছরের সুশান্ত সিং রাজপুতের ঝুলন্ত দেহ। নিজের বেডরুমের সিলিং ফ্যান থেকে তিনি গলায় সবুজ রঙের পাঞ্জাবি দিয়ে আত্মঘাতী হন। কোনও সুইসাইড নোট তিনি রেখে যাননি। প্রাথমিকভাবে ঘটনার তদন্তে নামেন বান্দ্রা পুলিশ। সুশান্ত সিং রাজপুত তার ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে শেষ পোস্ট করেছিলেন এক সপ্তাহ আগে যেখানে তাঁর প্রয়াত মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তিনি। এমন অবাক করা মর্মান্তিক ঘটনায় শোকস্তব্ধ বলিউড শ্রদ্ধা জানাতে শুরু করে তরুণ অভিনেতাকে। সুশান্তের মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেই প্রাক্তন ম্যানেজার দিশা সালিয়ান আত্মহত্যা করেন। কাই পো চে ছবির মাধ্যমে বলিউডে আত্মপ্রকাশ করার পর কেদারনাথ, এম এস ধোনি, রাবতা, পিকে, ছিচোঁড়ে, শুদ্ধ দেশি রোম্যান্স-এর মতো ছবি তিনি দর্শকদের উপহার দিয়েছেন। শেষ ছবি দিল বেচারা তাঁর মৃত্যুর পর মুক্তি পায়।

বান্দ্রা পুলিশের তদন্ত
প্রাথমিকভাবে এই ঘটনার তদন্তে নামে বান্দ্রা পুলিশ। পুলিশ তদন্তের সময় জানতে পারে যে সুশান্ত বেশ কয়েকমাস ধরে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছেও নিয়মিত যেতেন চিকিৎসার জন্য। বান্দ্রা পুলিশ তদন্তে নেমে বলিউডের বেশ কিছু জনপ্রিয় পরিচালক-প্রযোজকদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায়। বয়ান রেকর্ডের জন্য ডেকে পাঠানো হয় সুশান্তের বর্তমান প্রেমিকা রিয়া চক্রবর্তীকেও। এছাড়াও আদিত্য চোপড়া ও মহেশ ভাট এবং সঞ্জয় লীল বনশালির মতো খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বদের বয়ানও রেকর্ড করা হয়। সুশান্তের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বাড়ির পরিচারক থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্যদের এই ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর পুলিশ এই ঘটনাকে নিছকই অবসাদের জন্য আত্মহত্যার নাম দেয়। এমনকী ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও দম বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কারণকে দেখানো হয়।

সোশ্যাল মিডিয়া ও বলিউডের একাংশের বক্তব্য
সুশান্ত সিং রাজপুতের আত্মহত্যার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরই বলিউডের স্বজন-পোষণ নিয়ে সরব হয় সোশ্যাল মিডিয়া ও হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির একাংশ। স্বজন-পোষণের অভিযোগ উঠতে থাকে করণ জোহর, আলিয়া ভাট, সোনম কাপুর, মহেশ ভাট সহ অন্যান্য অভিনেতা-পরিচালক-প্রযোজকদের ওপর। বলিউডের একাংশ দাবি করতে থাকে যে যশরাজ প্রযোজনার সঙ্গে তিনটে ছবি করার চুক্তি থাকলেও সুশান্ত একটা ছবি করার পরই সেই চুক্তি ভেঙে যায়। এরপর থেকেই তাঁর ঝুলিতেও ছবির সংখ্যা ক্রমশঃ কমতে থাকে এবং তিনি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তবে অনেকেই সুশান্তের এই মৃত্যুকে আত্মহত্যার নাম দিতে নারাজ ছিলেন। সুশান্তকে খুন করা হয়েছে বলে এই দাবিতে অনড় থাকেন অনেকে।

মহেশ ভাট ও রিয়া চক্রবর্তীকে নিয়ে পোস্ট
এরই মাঝে পরিচালক মহেশ ভাট ও সুশান্তের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীর সম্পর্ক নিয়ে জলঘোলা চলতে থাকে সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরিচালক ও রিয়ার পুরনো ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে সুশান্তের মৃত্যুর পেছনে এঁরা দায়ি বলে নেটিজেনরা নিজেদের রায় দিতে শুরু করে। যার জন্য রিয়া চক্রবর্তীর ব্যক্তিগত জীবনেও এর প্রভাব পড়ে।

পাটনা পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের
গত ২৫ জুলাই বিহারের পাটনা পুলিশের কাছে সুশান্ত সিং রাজপুতের বাবা অভিনেত্রী ও সুশান্তের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা ও প্রয়াত অভিনেতার অ্যাকাউন্ট থেকে ১৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ আনেন। তদন্তের জন্য পাটনা পুলিশ বিশেষ দল গঠন করে। অন্যদিকে মহারাষ্ট্র সরকার ও মুম্বই পুলিশের পক্ষ থেকে ক্রমাগত এটা বলা হয় যে সুশান্তের মৃত্যু তদন্ত করছে বান্দ্রা পুলিশ এবং পাটনা পুলিশের এখতিয়ার নয় এখানে এসে তদন্ত করার। তা সত্ত্বেও পাটনা পুলিশের বিশেষ দল মুম্বইতে তদন্তের জন্য পৌঁছায়। তবে মুম্বইতে এসে তাদের কোয়ারেন্টাইনের নামে সমস্যার মুখে ফেলে মুম্বই পুলিশ-প্রশাসন। তবে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে সেই প্রতিবন্ধকতা কেটে যায়।

এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের তদন্ত শুরু
বিহার পুলিশের কাছে সুশান্ত সিংয়ের বাবার দায়ের করা ১৫ কোটি টাকার আত্মসাতের মামলার তদন্ত ভার চলে আসে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বা ইডির কাছে। ইডি সুশান্তের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে এ বিষয়ে। ইডি দপ্তরে বারংবার হাজিরা দিতে আসেন রিয়া। ইডি অভিনেত্রীর ফোনও নিজেদের কাছে জমা রেখে দেয়। সুশান্তের যে ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট ছিল, তাও খতিয়ে দেখে ইডি। তবে ইডির রিপোর্টে ১৫ কোটি টাকার কোনও লেনদেন সুশান্তের অ্যাকাউন্ট ঘেঁটে পাওয়া যায়নি।

সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার
সুশান্ত মৃত্যু তদন্তের অগ্রগতির জন্য ও সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের দ্বারস্থ হন অভিনেতার বাবা। অবশেষে নীতীশ কুমারের হস্তক্ষেপে ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সুশান্ত মামলার তদন্তভার চলে যায় সিবিআইয়ের হাতে। তদন্তভার হাতে পেয়েই সিবিআই প্রথমেই রিয়া চক্রবর্তীকে সমন পাঠায়। সুশান্ত-রিয়ার সম্পর্ক থেকে শুরু করে, সুশান্তের কর্মজীবন, তাঁর মানসিক অবসাদ সহ বহু বিষয় উঠে আসে। তদন্তে জানা যায়, রিয়া চক্রবর্তী লকডাউনের কিছুদিন পর থেকেই সুশান্তের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন কিন্ত গত ৮ জুন সুশান্তের দিদি তাঁর সঙ্গে থাকতে আসছিলেন বলে রিয়া তাঁর নিজের বাড়ি চলে যান এবং এরপর দু'জনের মধ্যে আর কোনও যোগাযোগ ছিল না। সিবিআই ও ইডির অনবরত তদন্তেই মাদক সেবনের বিষয়টি উঠে আসে। ইডির হাতে একটি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট আসে, যেখানে রিয়া সহ সুশান্ত ও তাঁর কিছু বন্ধু-ম্যানেজার ওই গ্রুপে ছিলেন এবং তাঁরা ক্রমাগত মাদক নিয়ে আলোচনা করছেন।

নার্কোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো
সুশান্ত সিংমৃত্যু মামলায় মাদক যোগ উঠতেই গোটা দৃশ্যটাই এক লহমায় বদলে গেল। এনসিবির পক্ষ থেকে পরপর তিনদিন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হয় রিয়া চক্রবর্তী ও তাঁর ভাই শৌভিককে। এনসিবির জেরায় ভেঙে পড়ে রিয়া জানান যে তিনি সুশান্তকে মাদক দিতেন এবং তা নিয়ে আসত তাঁর ভাই শৌভিক। সুশান্ত মামলায় প্রথম গ্রেফতার হন রিয়া চক্রবর্তী। এরপর বিভিন্ন সূত্র ও হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট খতিয়ে দেখে বলিউড মাদক কাণ্ডের সঙ্গে নাম জড়িয়ে যায় শ্রদ্ধা কাপুর, সারা আলি খান, রাকুল প্রিত সিং ও দীপিকা পাড়ুকোনের মতো জনপ্রিয় বলিউড তারকাদের নাম। এনসিবি সকলকে এই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করেন। বলিউড মাদক কাণ্ডের তদন্ত সিবিআই এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে একমাস বায়কুল্লা জেলে থাকার পর জামিনে ছাড়া পেয়ে যান রিয়া।

সিবিআই সুশান্ত মামলার তদন্তের মীমাংসা করে দেয়
সুশান্ত মামলার বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখে, সুশান্তের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে সিবিআই এটা নিশ্চিত হয় যে অভিনেতা আত্মহত্যাই করেছেন এবং এই মৃত্যুর পেছনে কোনও ষড়যন্ত্র বা খুন হওয়ার চিহ্ন নেই। সিবিআইয়ের গঠন করা এইমসের বিশেষ চিকিৎসকের দলও ময়নাতদন্তের রিপোর্টে এই মৃত্যুকে আত্মহত্যাই বলেছে। যদিও সুশান্তের পরিবারের বিশ্বাস অভিনেতাকে খুন করা হয়েছে।

হাথরস কাণ্ডের প্রতিবাদে আজও ফুঁসছে ভারত! ২০২০ সাল জুড়েই প্রশ্নের মুখে যোগী রাজ্যের নারী নিরাপত্তা