মৃণাল সেনের ছবি মানেই ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ফিল্ম-দর্শন বুঝতে দেখতেই হবে এই ছবিগুলি
মৃণাল সেনের তৈরি ৮টি ক্লাসিক চলচ্চিত্রের তালিকা। এই ফিল্মগুলি প্রত্যেকের দেখা উচিত।
মৃণাল সেন। ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিত রায়ের সঙ্গে বাংলা সিনেমা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেওয়ার তৃতীয় স্তম্ভ। বলিউডের বানিজ্যিক ধারার ছবির পাশাপাশি সমাজের রুঢ় বাস্তবকে রুপোলি পর্দায় তুলে এনে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন এই তিনজন। তবে ঘটক ও রায়ের মতোই সেনও নিজস্ব চলচ্চিত্র দর্শনে ছিলেন একেবারে স্বতন্ত্র।
সারা জীবন নিজেকে ভেঙেছেন এই বাঙালী পরিচালক। ১৯৫৫ সালে 'রাত ভোর ' ছবি দিয়ে পরিচালনার জগতে পা রাখলেও মৃণাল সেন আন্তর্জাতিক পরিচিতি লাভ করেন 'ভুবন সোম' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। যা ভারতে 'নিউ সিনেমা' ফিল্ম আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। যার হাত ধরে ভারতীয় সিনেমা পায় শ্যাম বেনেগাল, গুলজার, মনি কল, রাজিন্দর সিং বেদি-দের।
আজীবন মার্ক্সবাদী মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রে, বার বার এক্সিস্টেন্সিয়ালিজম, স্যুররিয়ালিজম, জার্মান এক্সপ্রেশনিজম, ইটালিয়ান নিওরিয়ালিজম ইত্যাদি দর্শন উঠে এসেছে। শহর কলকাতা তাঁর চলচ্চিত্রের অন্যতম চরিত্র হয়ে উঠেছে বারে বারে। ক্রমশ বর্ণনামূলক ধারা থেকে সরে এসে দৃশ্য় নির্ভর হয়ে উঠেছিল তাঁর ফিল্ম। তবে, তাঁর চলচ্চিত্র দর্শনকে উপলব্ধি করতে হলে দেখতে হবে তাঁর ফিল্ম।
ভুবন সোম (১৯৬৯)
আগেই বলা হয়েছে 'ভুবন সোম'-এর হাত ধরেই ভারতে 'নিউ সিনেমা'-র পথ চলা শুরু হয়েছিল। ভারতীয় সিনেমা ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই ফিল্মে মৃণালের হাত ধরেছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা উৎপল দত্ত। এই চলচ্চিত্রে তিনি ছিলেন এক পশ্চিমী কেতায় অভ্যস্ত রেলওয়ে অফিসারের ভূমিকায়। গুজরাতে হাঁস শিকার করতে গিয়ে যিনি আমলাতন্ত্রের বাইরের জীবনের সহজ সরল আনন্দকে আবিষ্কার করেন। এক সাঁওতাল মেয়ের ভূমিকায় ছিলেন সুহাসিনী মুলে। এছাড়া কে কে মহাজনের অনবদ্য সিনেম্য়াটোগ্রাফিও এই ছবির সম্পদ। এই ফিল্মের জন্য সেরা ছবি ও সেরা পরিচালক বিভাগে দুটি জাতীয় পুরস্কার জিতেছিলেন মৃণাল সেন।
মৃগয়া (১৯৭৬)
'মৃগয়া'-তে মিঠুন চক্রবর্তী ছিলেন এক আদিবাসী শিকারীর ভূমিকায়। শিকারী হিসেবে সুনাম কুড়িয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের কাছেও। কিন্তু ধার শোধ করতে না পারায় এক মহাজন তাঁর স্ত্রীকে অপহরণ করে। সেই মহাজনকে হত্যার দায়ে তাঁর বিচার ও মৃত্যুদণ্ড এবং তাকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ ও জমিদারদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের জোট বাঁধা - এই নিয়েই এগিয়েছে কাহিনী। এই ফিল্মও সেরা চলচ্চিত্রের জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিল। আর মিঠুন চক্রবর্তী পেয়েছিলেন সেরা অভিনেতার সম্মান।
আকাশ কুসুম (১৯৬৫)
এই ফিল্মে মৃণাল সেনের সঙ্গে জোট বেঁধেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্য়ায়। এক মধ্যবিত্ত যুবকের আকাশ কুসুম ছোঁয়ার কাহিনী। শুভেন্দু চট্টোপাধ্য়ায় ছিলেন মধ্যবিত্ত যুবক সৌমিত্রের বিত্তবান বন্ধুর ভূমিকায়। সৌমিত্রের বড়লোক প্রেমিকার ভূমিকায় অভিনয় করেন অপর্না সেন। ফিল্মে সৌমিত্র নিজের দৈন্যতা অপর্নার কাছে গোপন রাখতে তার বড়লোক বন্ধুর কাছ থেকে একটি গাড়ি ও দামী থাকার জায়গা ধার নেয়। কিন্তু কোনওদিনই নিজের আসল অবস্থা প্রেমিকার কাছে উন্মুক্ত না করতে পারায় প্রেমে ও জীবনে ব্যর্থ হয় সেই যুবক।
খণ্ডহার (১৯৮৪)
১৯৮৪ সালের এই ফিল্মে একদল যুবক গ্রামের এক বাড়িতে যায় পিকনিকে। সেখানকার এক ভাঙাচোরা বাড়িতে ওঠে তারা। সেই বাড়িতে এক অন্ধ, অসুস্থ মা ও তাঁর একমাত্র মেয়ে থাকে। অন্ধ মায়ের ধারণা হয়, এই যুবকদের একজনের সঙ্গেই তাঁর মেয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এই মেয়ের ভূমিকায় ছিলেন শাবানা আজমি। যুবকদের মধ্যে এক ফটোগ্রাফারের ভূমিকায় ছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ। করুণা বশতঃ তিনি সেই অন্ধ মায়ের সামনে তাঁর মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে যান। ঘটনাচক্রে তাদের সেখানে কয়েক সপ্তাহ থাকতে হয়। এই ফিল্মের জন্যও মৃণাল সেন সেরা পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার জিতেছিলেন।
একদিন প্রতিদিন (১৯৭৯)
এই ফিল্মে মৃণাল সেন সমাজে মহিলাদের নিয়ে প্রচলিত নিয়ম কানুন নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন। ফিল্মে দেখানো হয় এক পরিবার তাদের বড় মেয়ের রোজগারের উপর নির্ভরশীল। এমনকী, তার বেকার বড় দাদার প্রতিদিনের খরচও বহন করে সেই মেয়ে। এক রাতে সে বাড়ি ফেরে না। তাই নিয়ে উদ্বেগে দুশ্চিন্তায় দিসাহারা হয়ে যায় তা পরিবার। কিন্তু সেই উদ্বেগ কি ভালবাসার? নাকি জীবন যাপনের একমাত্র উপায় হারানোর? সমাজের প্রতি এই খোলা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েই পরিচালক হিসেবে আরও একটি জাতীয় পুরস্কার জিতে নেন মৃণাল।
ইন্টারভিউ (১৯৭০)
মৃণালের 'কলকাতা ট্রিলোজি'-র প্রথম অংশ ছিল ইন্টারভিউ। এই চলচ্চিত্রে রঞ্জিত মল্লিক ছিলেন এক সপ্রতিভ বাঙালী যুবকের ভূমিকায়। এক পারিবারিক বন্ধু, তাকে এক সাহেবি সংস্থায় চাকরি করে দেওয়ার কথা বলে। শর্ত একটাই পশ্চিমী ধাঁচের স্যুট পড়ে তাঁকে ইন্টারভিউতে উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু ইন্টারভিউয়ের দিনই ধর্মঘট হওয়ায় সে লন্ড্রি থেকে স্যুট আনতে পারে না। একজনের কাছ থেকে স্যুট ভাড়া নিলেও গোলালে তা হারিয়ে যায়। শেষে বাঙালী ধুতি পাঞ্জাবি পড়েই সে ইন্টারভিউ দিতে হাজির হয়।
কলকাতা ৭১
সাতের দশকের রাজনৈতিক হিংসা দুর্নীতি উঠে এসেছে 'কলকাতা ট্রিলোজি'-র দ্বিতীয় ছবিতে। চারটি গল্পকে এক সুতোয় গেঁথে মৃণাল এই ছবি তৈরি করেছিলেন। এর জন্য ১৯৬৬ সাল থেকে তিনি কলকাতার বিভিন্ন ঘটনার ফুটেজ সংগ্রহ করেছিলেন। পাঁচ বছর ধরে তৈরি করেছিলেন এই ফিল্ম।
পদাতিক (১৯৭৩)
'কলকাতা ট্রিলোজি'-র তৃতীয় ছবি ছিল পদাতিক। সাতের দশকের শুরুর কলকাতার ছবি উঠে এসেছে এই ছবিতে। ফিল্ম জুড়ে সেই সময়ের কলকাতার টুকরো টুকরো হতাশার ছবি এঁকেছেন মৃণাল। ছবির শুরুতে স্ক্রিনে সংবাদপত্রের হেডলাইন রোল করতে দেখা যায়। এই বিষয় মাঝে মাঝেই ফিল্মে ফিরে এসেছে। যার ফলে গোটা ফিল্ম জুড়েই কোনও এমন এক ভাব তৈরি হয়েছিল যাতে মনে হয় প্রতিমুহূর্তেই সংকটের ঢেউ আছড়ে পড়তে চলেছে।