মারুতি 'গরিমা' হারাতে চলেছে গুরুগ্রাম, ঘুরে দাঁড়াতে কি পারবে মিলেনিয়াম সিটি
এই কাহিনি একটা গ্রামের শহর হয়ে ওঠার। বছর চল্লিশ আগেও ঠিক কতজন গুরগাঁও নামটার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তা হাতে গুণে বলে দেওয়া যায়। দিল্লির উপকন্ঠে একটি ছোট্ট জনপদ। যা অবস্থান হরিয়ানা নামক রাজ্যের মধ্যে।
এই কাহিনি একটা গ্রামের শহর হয়ে ওঠার। বছর চল্লিশ আগেও ঠিক কতজন গুরগাঁও নামটার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তা হাতে গুণে বলে দেওয়া যায়। দিল্লির উপকন্ঠে একটি ছোট্ট জনপদ। যার অবস্থান হরিয়ানা নামক রাজ্যের মধ্যে। কিন্তু ভৌগলিক অবস্থানে দিল্লির খুব কাছে । দূরত্ব মেরে-কেটে ৩২ কিলোমিটার। হরিয়ানা সরকার শিল্প-বান্ধব পরিবেশ তুলে ধরতে যে এক সহজ জমি হস্তান্তরের নীতি নিয়েছিল তার মধ্যে গুরগাঁও-এরও নাম ছিল।
ফলতই ১৯৮০ সালের শেষে সরকার যখন ধীরে-ধীরে অর্থনীতির আগলটাকে মুক্ত অর্থনীতির সামনে আলগা করছিল তখন থেকে যেন ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে গুরগাঁও-এর। তখনও এই জনপদের নাম গুরুগ্রাম হয়নি। যদিও, সত্তর দশকেই গুরগাঁও-এ দফতর খুলে ফেলেছিল সূর্য রাম মারুতি টেকনিক্যাল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড। তখন মারুতির কাজ ছিল কীভাবে দেশীয় প্রযুক্তিতে গাড়ি তৈরি করা যাবে তার প্রযুক্তি জ্ঞান প্রচার করা। যার মধ্যে ছিল গাড়ির নকসা থেকে শুরু করে গাড়ি তৈরি এবং কার অ্য়াসেম্বলিং।
এত সত্ত্বেও গুরগাঁও একটা ছোট্ট জনপদ ছাড়া আর কিছু ছিল না। দিল্লির মধ্যে ভারী শিল্প গড়ার মতো পর্যাপ্ত জমির অভাব থাকায় গুরগাঁও-এর মতো স্থানগুলি ছিল বিনিয়োগকারীদের পছন্দের। কয়েক কিলোমিটার দূরেই দিল্লি এয়ারপোর্ট এবং রেল স্টেশন। সবমিলিয়ে সত্তরের দশকে শিল্প-মানচিত্রে পা রাখা গুরগাঁও-এর শিখরে ওঠাটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। ১৯৭১ সালে এই সূর্য রাম মারুতি টেকনিক্যাল সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে মিশে যায় মারুতি লিমিটেড নামে একটি সংস্থা। ১৯৭৭ সালে এই মারুতি উদ্যোগ লিমিটেডকে লিকুইডেশনের মাধ্যমে তৈরি করা হয় মারুতি উদ্যোগ লিমিটেড নামে নয়া সংস্থা। এই নয়া সংস্থা এবার দেশীয় গাড়ি তৈরির পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু, এতে খুব একটা সাফল্য আসেনি। ইতিমধ্যে ইন্দিরা সরকার মুক্ত অর্থনীতির লক্ষ্যে ভারতের দরজাটা একটু ফাঁক করার নীতি নেয়। যার হাত ধরে মারুতি উদ্য়োগ লিমিটেডের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধে জাপানি সংস্থা সুজুকি।
এই যৌথ-উদ্যোগ গুরগাঁও-র অর্থনীতির কপালটাকেই বদলে দেয়। মারুতি আর গুরগাঁও নামটা সমার্থক হয়ে যায়। এই শহরে ৩০০ একর জমির উপরে মারুতির গাড়ি তৈরির কারখানা। যেখানে এই মুহূর্তে বছরে ৭০০,০০০ গাড়ি তৈরি হয়। এছাড়াও ২৪০,০০০ কে-সিরিজ ইঞ্জিনও তৈরি হয় এখানে। গুরগাঁও-এর বিকাশকে আরও আকাশ ছোঁয়া করে দেয় নব্বই দশক-এর মুক্ত-অর্থনীতি। রাতরাতি বিভিন্ন কল-সেন্টার থেকে শুরু করে বিভিন্ন বহুজাতিক তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থার ডেস্টিনেশন হয়ে দাঁড়ায় গুরগাঁও। এর সঙ্গে ডিএলএফ-এর মতো রিয়্যাল এস্টেট গোষ্ঠীর কাজ। আন্তর্জাতিক মানের সুবিধা সম্পন্ন একাধিক অফিস তৈরি করতে শুরু করে ডিএলএফ। যা বহুজাতিক সংস্থাগুলির কাছে আকর্ষণীয় হয়। গুরগাঁও রাতারাতি ভারতের সেরা আউট-সোর্সিং শহরে পরিণত হয়। সফটওয়ার ডেভলপমেন্ট থেকে শুরু করে কল-সেন্টার- কি নেই গুরগাঁও-এ। পার ক্যাপিটা আয়ে ভারতের তৃতীয় শহর গুরগাঁও। এককালে একটা পাণ্ডব-বর্জিত গ্রাম বর্তমানে এক অত্য়াধুনিক শহর। তাকে এখন ডাকা হয় মিলিনিয়াম সিটি বলে। এখানে এই মুহূর্তে রয়েছে অন্তত ২৫০ 'ফরচুন ৫০০' সংস্থার দফতর। কিন্তু, গুরগাঁও-এর এই বিকাশে মারুতি কারখানার অবদান সবচেয়ে বেশি।
গুরগাঁও-এ মারুতির কারখানায় প্রতিদিন কাঁচামাল ভর্তি কয়েক হাজার ট্রাক আসে। আবার কয়েক শ'ট্রেলার করে তৈরি গাড়ি কারখানার বাইরে বিভিন্ন গন্তব্যে পাঠানো হয়। বছর ৩৫ আগে এই কারখানায় ট্রাক ও ট্রেলার ঢোকা-বেরনোয় কোনও সমস্যা হত না। কিন্তু, গুরগাঁও এখন একটা ওভার-ক্রাউডেড সিটি। এখানে অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও এই শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। এমন একটা বাণিজ্য শহরের রাস্তা-ঘাটের যতটা পরিসর থাকা উচিত ততটা নয়। ফলে মারুতির কারখানায় ঢোকা এবং বের হাওয়া ট্রাক ও ট্রেলারের জন্য গুরগাঁও-এর রাতদিন যানজট লেগেই থাকে। ফলে শহরের নাগরিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। এতে সমস্যা বাড়ছে মারুতি কারখানারও। তারমধ্যে কারখানা সম্প্রসারণ দরকার। কিন্তু, গুরগাঁও-এ পর্যাপ্ত জমি নেই মারুতি কারখানা সম্প্রসারণের।
এহেন পরিস্থিতিতে গুরগাঁও কারখানাকে অন্যত্র সরানো ছাড়া আর কোনও উপায় দেখতে পাচ্ছে না মারুতি-সুজুকি প্রাইভেট লিমিটেড। গুরুগাঁও থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে সোহনা নামে একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল মডেল টাউনশিপকে চিহ্নিতও করা হয়েছে। সেখানে অন্তত ১,৩০০ একর জমি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে জমি পাওয়ার বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নয়। তবে, মারুতির চেয়ারম্যান আর সি ভারগাভা জানিয়েও দিয়েছেন গুরগাঁও থেকে ধাপে ধাপে উৎপাদন অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। সুতরাং, এটা পাকা যে গুরগাঁও থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে মারুতি। আর এখানেই একটা প্রশ্ন বারবার উঠে আসছে, আর সেটা হল মারুতি চলে গেলে এই মিলেনিয়াম সিটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির গ্রাফে নিজের জায়গাটা ধরে রাখতে সমর্থ হবে তো?
এখানেই চলে আসছে নিউ ইয়র্ক, ডেট্রয়ট-এর উদাহরণ। নিউ ইয়র্ক সিটি একটা সময় আমেরিকার শিপিং ইকোনমির পীঠস্থান ছিল। কিন্তু, সত্তরের দশকে এই শিপিং ইকোনমির ডেস্টিনেশন আমেরিকার উত্তরে সরে যায়। কিন্তু, নিউ ইয়র্ক সিটি পরিষেবা ব্যবসায় দ্রুত নিজের জায়গা করে নেয় এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিনান্সিয়াল হাব-এ পরিণত হয়। অন্যদিকে ডেট্রয়ট একটা সময় গাড়ি তৈরিতে বিশ্বের এক নম্বর শহর ছিল। কিন্তু, আস্তে আস্তে সেই তকমা খোয়ায় এই শহর। নতুন করে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ডেট্রয়ট।
[আরও পড়ুন:মুখ লুকোনোর জায়গা নেই! আরও নেমে লজ্জার রেকর্ড গড়ল টাকা ]
অর্থনৈতিক বিষেশজ্ঞদের মতে, গুরুগ্রামও-কে নতুন পথের সন্ধান করতে হবে। খতিয়ে দেখতে হবে তাঁর নতুন অর্থনৈতিক বিকাশের রাস্তাটাকে। এই মুহূর্তে আউটসোর্সিং-এর কাজের শিখরে পৌঁছানোর মতো রসদ রয়েছে এই শহরের কাছে। হরিয়ানা সরকারকেও ভাবতে হবে যে গুরুগ্রাম-এর মতো ওভার-ক্রাউডেড সিটিতে মারুতির মতো ভারী শিল্প সম্ভব নয়। সেখানে বিকল্প শিল্পের রাস্তা খুলতে হবে। না হলে গুরুগ্রাম তার গরিমা হারাতে পারে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
[আরও পড়ুন: চাই অর্থনীতিতে গতি! নতুন সিদ্ধান্ত মোদী সরকারের]