নবরাত্রি ও নবদুর্গা নিয়ে অজানা কিছু তথ্য
পূর্বে রামের প্রতি অনুগ্রহ করে রাবণ বধে তাঁকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা রাত্রিকালে এই মহাদেবীর বোধন করেছিলেন। বোধিতা হয়ে দেবী গেলেন রাবণের বাসভূমি লঙ্কায়। সেখানে তিনি রাম ও রাবণকে দিয়ে সাত দিন ধরে যুদ্ধ করালেন। নবমীর দিন জগন্ময়ী মহামায়া রামের দ্বারা রাবণ বধ করেন। যে সাত দিন দেবী রামরাবণের যুদ্ধ দেখে আনন্দ করলেন, সেই সাত দিন দেবতারা তাঁর পূজা করেন। রাবণ নিহত হলে নবমীর দিন ব্রহ্মা সকল দেবতাকে সঙ্গে নিয়ে দেবীর বিশেষ পূজা করলেন। তারপর দশমীর দিন শবরোৎসব উদযাপিত হল। শেষে দেবীর বিসর্জন হল।
এখানে রাত্রিকাল কথাটির একটু ব্যাখ্যা প্রয়োজন। এই ব্যাখ্যার মধ্যেই রয়েছে, শরৎকালকে রাম কেন দুর্গাপূজার পক্ষে অকাল বলেছিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর। সূর্যের দক্ষিণায়ণ দেবতাদের রাত। এই সময় দেবতারা ঘুমান। শরৎকাল পরে দক্ষিণায়ণের সময়। এই সময় দেবতাকে পূজা করতে হলে, তাকে জাগরিত করতে হয়। এই প্রক্রিয়াটিই হল বোধন।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। এই পুরাণের মতে, কুম্ভকর্ণের নিদ্রাভঙ্গের পর রামচন্দ্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় দেবতারা হলেন শঙ্কিত। তখন ব্রহ্মা বললেন, দুর্গাপূজা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। তাই রামচন্দ্রের মঙ্গলের জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা যজমানী করতে রাজি হলেন। তখন শরৎকাল। দক্ষিণায়ণ। দেবতাদের নিদ্রার সময়। এতএব ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করলেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন, বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে। দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি পরমাসুন্দরী বালিকা।
ব্রহ্মা বুঝলেন, এই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধন-স্তবে তাঁকে জাগরিত করলেন। ব্রহ্মার স্তবে জাগরিতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চণ্ডিকামূর্তি ধরলেন। ব্রহ্মা বললেন, "রাবণবধে রামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য তোমাকে অকালে জাগরিত করেছি। যতদিন না রাবণ বধ হয়, ততদিন তোমার পূজা করব। যেমন করে আমরা আজ তোমার বোধন করে পূজা করলাম, তেমন করেই মর্ত্যবাসী যুগ যুগ ধরে তোমার পূজা করবে। যতকাল সৃষ্টি থাকবে, তুমিও পূজা পাবে এইভাবেই।" একথা শুনে চণ্ডিকা বললেন, "সপ্তমী তিথিতে আমি প্রবেশ করব রামের ধনুর্বাণে। অষ্টমীতে রাম-রাবণে মহাযুদ্ধ হবে। অষ্টমী-নবমীর সন্ধিক্ষণে রাবণের দশমুণ্ড বিচ্ছিন্ন হবে। সেই দশমুণ্ড আবার জোড়া লাগবে। কিন্তু নবমীতে রাবণ নিহত হবেন। দশমীতে রামচন্দ্র করবেন বিজয়োৎসব।" হলও তাই। মহাবিপদ কেটে গেল অষ্টমীতে; তাই অষ্টমী হল মহাষ্টমী। রাবণ বধ করে মহাসম্পদ সীতাকে লাভ করলেন রাম; তাই নবমী হল মহানবমী।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে দুর্গাপূজা করেছিলেন রাম। কিন্তু পুরাণ বলে, রামের মঙ্গলের জন্য দেবগণ করেছিলেন পূজার আয়োজন। পুরোহিত হয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা। কৃত্তিবাসের দুর্গাপূজা বিবরণে বাংলায় প্রচলিত লৌকিক প্রথার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই বিবরণ সম্পূর্ণ শাস্ত্রানুগ নয়। যদিও কৃত্তিবাসকে ধরে লোকে আজকাল মনে করে, শরৎকালের দুর্গাপূজার সূচনা করেছিলেন রাম। কিন্তু এই সম্মান বুড়ো ঠাকুরদাদারই পাওয়া উচিত। আমাদের মনে রাখা উচিত, বাংলার লক্ষ লক্ষ দুর্গাপূজায় আজও বোধনের মন্ত্রে উচ্চারিত হয়:
ওঁ ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ।
অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যস্তয়ি কৃতঃ পুরা।।
অহমপাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়মি বৈ।
(হে দেবী, রাবণবধে রামকে অনুগ্রহ করার জন্য ব্রহ্মা তোমার অকালবোধন করেছিলেন, আমিও সেইভাবে আশ্বিন মাসের ষষ্ঠী তিথিতে সন্ধ্যায় তোমার বোধন করছি।)
ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্র শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রচলন করেন । রাবণবধ ও সীতাউদ্ধারের জন্য রামচন্দ্র দুর্গতিনাশিনী দুর্গার অকালবোধন করে নবরাত্র ব্রত পালন করেছিলেন।
নবরাত্র ব্রত আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত । মা দুর্গা এই সময় অর্থাত আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ তিথি থেকে নবমী অবধি মোট ন'দিন নয়টি রূপ ধারণ করেন। পিতামহ ব্রহ্মা দেবীর এই নয়টি রূপের নামকরণ করেছিলেন। নয়টি নামের নয়টি বৈচিত্রময় রূপভেদ। এঁরা প্রত্যেকেই দেবীর নয়টি কায়াব্যূহ মূর্তি। নবদুর্গা নামে এঁরা বিশেষ পরিচিত। শ্রীশ্রী চন্ডীতে এই নয়টি নামের উল্লেখ আছে।
নবদুর্গার এই নয়টি নাম হল -
•শৈলপুত্রী ( পর্বতের কন্যা)
•ব্রহ্মচারিণী (যিনি ব্রহ্মাকে স্বয়ং জ্ঞান দান করেন, ভক্তকেও ইনি ব্রহ্মপ্রাপ্তি করান )
•চন্দ্রঘন্টা ( দেবীদুর্গার মহিষাসুর বধের জন্য দেবরাজ ইন্দ্রের প্রদত্ত ঘন্টা যার মধ্যে গজরাজ ঐরাবতের মহাশক্তি নিহিত ছিল, চন্দ্রের চেয়েও লাবণ্যবতী ইনি )
•কুষ্মান্ডা ( উষ্মার অর্থ তাপ । দুর্বিষহ ত্রিতাপ হল কুষ্মা। আর যিনি এই ত্রিতাপ নিজের উদরে বা অন্ডে ধারণ করেন অর্থাৎ সমগ্র সংসার ভক্ষণ করেন ইনি )
•স্কন্দমাতা ( দেব সেনাপতি কার্তিকেয় বা স্কন্দের মা )
•কাত্যায়নী ( কাত্যায়ন ঋষির আশ্রমে দেবকার্যের জন্য আবির্ভূতা ইনি বৃন্দাবনে দেবী গোপবালা রূপে পূজিতা। ব্রজের গোপবালারা এই কাত্যায়নীর কাছে প্রার্থণা করেছিলেন নন্দের নন্দন শ্রীকৃষ্ণকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য তাই ব্রজের দুর্গার নাম কাত্যায়নী )
•কালরাত্রি ( ঋগ্বেদের রাত্রিসুক্তে পরমাত্মাই রাত্রিদেবী। মহাপ্রলয়কালে এই রাত্রিরূপিণী মাতার কোলেই বিলয় হয় বিশ্বের।অনন্ত মহাকাশে নৃত্যরত কালভৈরবের দেহ থেকেই আবির্ভূতা ইনি দেবী যোগনিদ্রা মহাকালিকা বা কালরাত্রি নামে আখ্যাত )
•মহাগৌরী (তিনি সন্তানবত্সলা, শিবসোহাগিনী, বিদ্যুদ্বর্ণা মা দুর্গার প্রসন্ন মূর্তি) এবং
•সিদ্ধিদাত্রী
(
অপরূপ
লাবণ্যময়ী
চতুর্ভুজা,
ত্রিনয়নী,
প্রাতঃসূর্যের
মত
রঞ্জিতা
যোগমায়া
মাহেশ্বরী
ইনি
সকল
কাজে
সিদ্ধি
প্রদান
করেন
)
শ্রীশ্রীচন্ডীর
দেবীকবচ
অধ্যায়ের
তৃতীয়
থেকে
পঞ্চম
শ্লোকে
নবদুর্গার
উল্লেখ
আছেঃ
প্রথমং
শৈলপুত্রীতি
দ্বিতীয়ং
ব্রহ্মচারিণী।
তৃতীয়ং
চন্দ্রঘন্টেতি
কুষ্মান্ডেতি
চতুর্থকম্।।
পঞ্চমং
স্কন্দমাতেতি
ষষ্ঠং
কাত্যায়নী
তথা।
সপ্তমং
কালরাত্রীতি
মহাগৌরীতি
চাষ্টমম্।।
নবমং
সিদ্ধিদাত্রী
চ
নবদুর্গা
প্রকীর্তিতাঃ।
উক্তোন্যেতানি
নামানি
ব্রহ্মনৈবমহাত্মানা।।
শ্রীশ্রীচন্ডীতেই প্রথম মহিষাসুরমর্দ্দিণী মাদুর্গার নয়টি রূপের বর্ণনা ও মহিমা প্রকাশিত।
মহালয়ার সাথেসাথে কৃষ্ণপক্ষের অবসান হয়। দেবীপক্ষের সূচনা হয়। পরদিন অর্থাত শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত ন'টি রাত্রি অবধি মাদুর্গার নয়টি রূপের পুজো চলে। শরতকালীন এই নবরাত্রি উত্সবকে বলা হয় শারদ নবরাত্রি। মূলত এটি শক্তির আরাধনা। নবরাত্রির পরদিন বিজয়াদশমীর সাথে সাথে এই শক্তিপূজার সমাপন হয়।