আজ শারদীয় দুর্গাপূজোর মহাষ্টমী
শনিবার মহাসপ্তমী বিহিত থেকেই মূলত উৎসবের জোয়ার নামলো পূজায়। আর মাত্র দু'টি দিবানিশির প্রহর পেরুলেই উমার কৈলাশ গমন।' ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ'-এই সুর এখন ভক্ত প্রাণে। আজ শারদীয় দুর্গাপূজার মহাষ্টমী।
এদিকে দুর্গোৎসবের দ্বিতীয় দিন শনিবার ছিল মহাসপ্তমী। এদিন ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন শেষে দেবীর মহাসপ্তমী বিহীত পূজা অনুষ্ঠিত হয়। পূজাশেষে যথারীতি অঞ্জলি প্রদান, প্রসাদ বিতরণ ও ভোগ আরতির আয়োজন ছিল। বিভিন্ন মন্দিরের পুরোহিতরা জানিয়েছেন, দুর্গাকে বিশেষ রীতি অনুসারে স্নান করানো হয়। দুর্গার প্রতিবিম্ব আয়নায় ফেলে বিশেষ ধর্মীয় রীতিতে তা স্নান করানোর পর বস্ত্র ও নানা উপচারে মায়ের পূজা দেয়া হয়। মন্দিরগুলোতে দেবী দর্শনের জন্য দর্শনার্থীদের ঢল নামে। বিভিন্ন মন্দির-মন্ডপে ভক্তরা মা দুর্গাকে দর্শন ও প্রার্থনায় সমবেত হন। মুখরিত হয়ে উঠে প্রতিটি মন্দির প্রাঙ্গণ।
এদিকে বিশুদ্ধ পঞ্জিকা মতে, পূর্বাহ্ন ৯-৫৮ মধ্যে শ্রী শ্রী দুর্গাদেবীর মহাষ্টমী কল্পারম্ভ ও মহাষ্টমী বিহিত পূজা প্রশস্ত। রাত্রি ১১-৪ গতে সন্ধি পূজা আরম্ভ। আগামী সোমবার মহানবমী পূজা। নির্ঘণ্ট অনুযায়ী পূর্বাহ্ন ৯-৫৭ মধ্যে শ্রী শ্রী দুর্গাদেবীর মহানবমী কল্পারম্ভ ও মহানবমী বিহিত পূজা প্রশস্ত। পূজান্তে অঞ্জলি প্রদান দেশ ও বিশ্বশান্তিকল্পে ও মঙ্গলার্থে সমবেত প্রার্থনা।
মহাষ্টমীর এ দিন শারদীয় দুর্গাপূজার সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং জাঁকজমকপূর্ণ দিন আজ। দেবীর সন্ধিপূজা এবং কুমারী পূজার মধ্য দিয়ে দিনটি পালন করবে হিন্দু ধর্মাবলম্ব্বীরা। মাতৃভাবে কুমারী কন্যাকে জীবন্ত প্রতিমা করে তাতে জগজ্জননীর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করাই কুমারী পূজা।
কুমারী পূজা প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ' কুমারী পূজা করে কেন ? সব স্ত্রীলোক ভগবতীর এক একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ। (কথামৃত-পৃষ্ঠা : ৪৬৭)।'
দেবী দুর্গা কুমারী নামে প্রসিদ্ধা। বৃহদ্ধর্মপূরাণে দেবতাদের স্তবে প্রীত হয়ে চণ্ডিকা কুমারী কন্যা রূপে দেবতাদের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে বিল্ববৃক্ষে দেবীর বোধন করতে বলেছিলেন।
" কন্যারূপে দেবানামগ্রতো দর্শনং দদৌ। "
দেবীপূরাণ মতে দেবীর পূজার পর উপযুক্ত উপচারে কুমারীদের ভোজনে তৃপ্ত করতে হবে-'নৈবেদ্যং শালিজং ভক্তং শর্করা কন্যাস্বপি।' শালিচালের ভাত, শর্করা (মিষ্টান্ন) প্রভৃতি নৈবেদ্য দ্বারা কুমারীদের ভোজন করাবে। দুর্গপূজায় কুমারীপূজা সংযুক্ত হয়েছে নিঃসন্দেহে তান্ত্রিক সাধনা থেকে। তান্ত্রিক মতে কুমারী দেবীর প্রতীক। যে কোন প্রসিদ্ধ শক্তিপীঠে কুমারীপূজার রীতি। কামরূপ কামাখ্যার মন্দিরে কুমারীপূজা করা হয়ে থাকে। কুমারীপূজার প্রাধান্য থেকেই বাঙ্গলা দেশে 'গৌরীদান প্রথা প্রচলিত হয়েছিল।
কুমারী পূজা ছাড়া হোম প্রভৃতি সকল কর্ম পরিপূর্ণ ফললাভ করে না। কুমারীপূজায় সেই ফল অবশ্যই লাভ হয়। কুমারীকে পুষ্প দিলে কার ফল হয় মেরুপর্বত সমান, কুমারীকে ভোজন করালে ত্রিলোককে ভোজন করানো হয়। দেবী শিবকে বলেছেন, ''কুমারিকা হুহং নাথ সদা ত্বং কুমারিকা।"
হে নাথ, আমিও কুমারী তুমিও কুমারী, অর্থাৎ সকল কুমারীই শিব- পার্বতীর অংশ।
কুমারী সাক্ষাৎ যোগিনী, কুমারী পরদেবতা-''কুমারী যোগিনী সাক্ষাৎকুমারী পরদেবতা।" মহানবমীতে কুমারী পূজার বিধান তন্ত্রসারেই আছে-মাহানবম্যাং দেবেশি কুমারীং চ প্রপূজয়েৎ। এক বৎসর থেকে ষোল বৎসর পর্যন্ত বালিকারা ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত কুমারীরূপে পূজিত হওয়ার যোগ্য। এক এক বর্ষীয়া কুমারীদের এক এক নাম আছে। একবৎসরের কন্যার নাম সন্ধ্যা, দ্বিবর্ষা কন্যা সরস্বতী, তিন বৎসরের ত্রিধামূর্তি, চতুবর্ষা কালিকা, পঞ্চবর্ষা সুভগা, ষড়বর্ষা উমা, সপ্তবর্ষা মালিনী, অষ্টবর্ষা কুজিকা, নববর্ষীয়া কন্যার নাম কালসন্দর্তা, দশমবর্ষীয়া অপরাজিতা, একাদশবর্ষীয়া কন্যাণী, দ্বাদশবর্ষা ভৈরবী, ত্রয়োদশবর্ষীয়া মহালক্ষ্মী, চতুর্দশবর্ষীয়া পীঠনায়িকা, পঞ্চদশবৎসরের কন্যার নাম ক্ষেত্রজ্ঞা ও ষোড়শ বর্ষীয়া কুমারী অম্বিকা।
দেবী কুমরীর নাম বহু প্রাচীন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকে দেবীকে কন্যা কুমারী বলা হয়েছে-
'' ক্যাত্যায়নায় বিদ্মহে কন্যাকুমারী ধীমাহি। তন্নো দুর্গি প্রচোদয়াং ॥"
-হে দুর্গে, তুমি কন্যা ও কুমারী, কত্যায়নকে জানি, তোমাকে ধ্যান করি, তুমি আমাদের প্রেরণ কর।
দেবী
পূরাণ
দেবীর
কৌমারী
নামের
ব্যাখ্যা
প্রসংগে
বলেছেন-
কুমার-রূপধারী
চ
কুমার-জননী
তথা।
কুমার-রিপুহন্ত্রী
চ
কৌমারী
তেন
সা
স্মৃতা
॥
কুমার রূপ ধারণ করেন, কুমারের জননী, কুমার রিপুনাশিনী বলেই তিনি কৌমারী নামে স্মৃতা।
উপনিষদে
ব্রহ্মকে
কুমার
এবং
কুমারী
দুইই
বলা
হয়েছে-
ত্বং
স্ত্রী
ত্বং
পুমানসি
ত্ব
কুমার
উত
বা
কুমারী।
ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে কন্যাকুমারী নামক বিখ্যাত পীঠে দেবীর কন্যা কুমারী বিগ্রহ দেবীর কুমারী নামের সার্থকতা প্রতিপাদন করে।
আজ সন্ধি পূজা
এটা সকলেরই জানা যে 'সন্ধি' মানে মিলন। যুদ্ধারতা মা দুর্গা কারও সঙ্গে সন্ধি করেননি। আসলে এই মুহূর্তটি হল অষ্টমী তিথি ও নমবী তিথির মিলন সময়। যেই সময়ে দু'টি তিথির মিলন ঘটে, সেই সময়টিকে মহাসন্ধিক্ষণ বলা হয়।
আরও স্পষ্ট করে অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট ও নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট মিলিয়ে মোট ৪৮ মিনিট সময়ের মধ্যে সাঙ্গ করতে হয় সন্ধি পুজো।
দুর্গাপূজায় এই সন্ধিক্ষণের বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে।পুরাণ অনুসারে অসুরদের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধের সময়ে দেবী অম্বিকার কপালে থাকা তৃতীয় নেত্র থেকে দেবী কালিকা প্রকট হয়েছিলেন ঠিক এই সময়কালে। আবার অন্যত্র এমনটাও বলা হয়েছে যে, পরাক্রমী অসুর রক্তবীজের সমস্ত রক্ত এই সন্ধি মুহূর্তেই দেবী চামুণ্ডা কালিকা খেয়ে ফেলেছিলেন। তাই পণ্ডিতেরা বলে থাকেন, এই সন্ধিক্ষণ চলাকালীন সময়ে মা দুর্গার অন্তর থেকে সমস্ত স্নেহ, মমতা অদৃশ্য হয়ে যায়। সেই কারণেই সন্ধি পূজার সময়ে দেবীর দৃষ্টি পথ পরিষ্কার রাখা হয়, চামুণ্ডা দুর্গার চোখের সামনে দাঁড়াতে নেই।
অনেক জায়গায় এই সন্ধিপূজা তে বলি দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। বহু জায়গায় ছাগ বলি হয়ে থাকলেও কলা, আঁখ, চালকুমড়ো ইত্যাদিও বলি দেওয়া যায়। বলি দান অষ্টমী তিথিতে নয়, সন্ধি পূজার প্রথম দণ্ড অর্থাৎ ২৪ মিনিট পার হওয়ার পরেই হয়।
শাস্ত্রে এই সন্ধি পূজার অনেক মহিমা বর্ণনা করা হয়েছে। সংযমী হয়ে উপবাসী থেকে সন্ধিব্রত পালন করলে নাকি যমদুখ থেকে মুক্তি মেলে। অর্থাৎ মৃত্যুর সময়ে মায়ের কৃপা লাভে যম স্পর্শ করতে পারে না। এমনও বলা হয় যে, ভক্তিভরে সন্ধি পূজায় যোগ দিলে সারা বছর দুর্গাপূজা না করেই সেই ফল লাভ করা যায়।
পণ্ডিত
নবকুমার
ভট্টাচার্যের
কথায়,
'এই
সময়ে
দশভূজা
দেবী
নয়
মুণ্ডমালিনী
চতুর্ভূজা
চামুণ্ডারূপে
পূজিতা
হন
দুর্গা।
আর
এই
পুজোয়
সকলেরই
যোগ
দেওয়ার
অধিকার
রয়েছে।
কিন্তু
মঙ্গল
লাভ
করতে
হলে
সত্যিকারের
উপবাস
প্রয়োজন।
উপ-বাস
অর্থাৎ
দেবী
সমীপে
বাস
করতে
হবে।
গোটা
দিন
দেবীর
জপ
করতে
হবে।
নিষ্ঠাভরে
পুজোতেই
মেলে
মঙ্গল।'তিনি
আরও
বলেন,
'আশ্বিণের
ষষ্ঠী
তিথিতে
দুর্গাপূজার
আয়োজন
করেছিলেন
শ্রীরামচন্দ্র।
বিভীষণ বিধান দিয়েছিলেন ১০৮টি লালপদ্ম দিয়ে দেবীর আরাধনা করলে দুর্গা প্রসন্না হবেন। কিন্তু পুজোর সময়ে রামচন্দ্র দেখেন একটি ফুল কম। সেই সময়ে তির-ধনুক তুলে নিজের একটি চোখ উপড়ে ফেলতে চান দশরথনন্দন। যদিও পুরোটাই ছিল মহামায়ার ছলনা। রামের ভক্তি দেখে দেবী নিজে আবির্ভূত হন। সেই ঘটনার থেকেই সন্ধি পুজোর সময়ে দেবীকে ১০৮টি পদ্ম নিবেদন করা হয়। সমসংখ্যাক প্রদীপ প্রজ্জ্বলন করা হয়।'
পণ্ডিতরা তাই এমনও বলেন যে, সন্ধি পুজোর সময়েই দেবী মহামায়া মৃন্ময়ী মূর্তি থেকে চিন্ময়ী রূপে আসেন ও ভক্তের পূজা গ্রহণ করেন। ১০৮ প্রদীপ জ্বেলে প্রার্থনা করতে হয় যাতে দেবী সংসারের সব আঁধার মোচন করেন। দেবী যেন জ্ঞানের আলো জ্বেলে দেন।
এই বছর সন্ধি পূজা কখন ?
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে রবিবার ৯ অক্টোবর সন্ধি পুজো। রাত্রি ১০টা ৭ মিনিটের পরে পূজা শুরু হবে। ১০টা ৩১ মিনিটের পরে সন্ধি পূজার বলিদান এবং রাত ১০টা ৫৫ মিনিটের মধ্যে পূজার সময় শেষ।