আজ মহাসপ্তমী : মহাদেবীর মহোৎসব
'মহা
মায়ের
মহামায়া
/
সোনার
আলোয়
কত
পাওয়া
/
ঊমাশশীর
শীতল
হাওয়া
/
চারটি
দিনের
অনেক
চাওয়া
/
কাঁদিস
নে
মা
উমা
ওরে,
আবার
তোরে
আসবো
নিয়ে
একটি
বছর
পরে।'
শুভের আগমনী গান বাংলার প্রকৃতিময় প্রতিফলিত হচ্ছে। দেবীকে বরণ করে নিতে প্রকৃতি, দোয়েলের ডাক, কাশফুল, শিউলী ঝরার শব্দ এরা সবাই অপেক্ষা করছে। শরৎ ঋতু ঘোষণা দিচ্ছে মায়ের পূজার সময় হয়েছে।
শান্তি, সাম্য আর ভ্রাতৃত্বের অমর বাণী শোনাতে এক বছর পরে শারদ উৎসবে স্বর্গালোক থেকে মর্ত্যে এসেছেন দুর্গতিনাশিনী মহামায়া মা দুর্গা।
পুরাণ মতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্তে এ পূজার আয়োজন করায় এ পূজাকে 'বাসন্তী পূজা' বলা হয়।
রামায়ণ যুগের অবতার শ্রী রামচন্দ্র লংকা অধিপতি রাবণের অশোক বনে বন্দি সহধর্মিণী সীতাকে উদ্ধার করতে যাত্রার আগে শরৎকালের আমাবস্যা তিথিতে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার স্ত‚তি করেছিলেন। অবতার রামচন্দ্রের শরৎকালের অকাল বোধনের তিথিতে প্রতিবছর বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় আয়োজন করে মহাদেবীর মহোৎসব।
বছরান্তে আশ্বিন-কার্তিকের পঞ্চমী থেকে দশমী তিথির পাঁচটি দিবস 'জগজ্জননী' উমা দেবীর পিতৃগৃহ ঘুরে যাওয়া। মণ্ডপে মণ্ডপে ঢাকের বোলে যেন ধ্বনিত হচ্ছে বাঙালি হিন্দুর হৃদয়তন্ত্রীতে বাঁধভাঙ্গা আনন্দের জোয়ার। দেশের হাজার হাজার পূজামণ্ডপ এখন উত্সব মাতোয়ারা।
ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে গতকাল শুক্রবার সকালে শুরু হয়েছে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ৫ দিনের শারদীয় দুর্গাপূজা।
৫ দিনব্যাপী সার্বজনীন এ ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে আনন্দ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা। উৎসবের প্রথম দিনে গতকাল ষষ্ঠীতিথিতে মণ্ডপে মণ্ডপে দেবীর অধিষ্ঠান হয়। সকালে ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ এবং বেলতলা কিংবা বেল গাছের নিচে দেয়া হয় ষষ্ঠী পূজা। দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা।ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনির শব্দ দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের জানান দিচ্ছে। পূজার মন্ত্রোচ্চারণ, আরতি আর মাইকের আওয়াজে এখন মাতোয়ারা সারা দেশের পূজামণ্ডপগুলো।
প্রতিটি
পূজামণ্ডপে
ধূপধুনো,
বেল-তুলসী,
আসন,
বস্ত্র,
নৈবেদ্য,
পুষ্পমাল্য,
চন্দনসহ
১৬টি
উপাচার
দিয়ে
দেবী
দুর্গাকে
আজ
পূজা
করা
হবে।
ত্রিনয়নী
দেবী
দুর্গার
চক্ষুদান
করা
হবে।
মহাসপ্তমীর
সকালে
সর্বপ্রথম
চক্ষুদানের
মধ্যদিয়ে
ত্রিনয়নী
দেবী
দুর্গার
প্রাণ
প্রতিষ্ঠা
করা
হয়।
হিন্দু
পুরাণ
মতে,
মহাসপ্তমীতে
ভক্তদের
কল্যাণ
ও
শান্তির
আশীর্বাদ
নিয়ে
হিমালয়
নন্দিনী
দেবী
দুর্গা
পূজার
পিঁড়িতে
বসবেন।
আজ
শারদীয়
দেবী
দুর্গার
নবপত্রিকা
প্রবেশ
ও
স্থাপন
করা
হবে।
এরপর
সপ্তম্যাদি
কল্পারম্ভ
ও
মহাসপ্তমী
বিহিত
পূজা
অনুষ্ঠিত
হবে।
দেহ
শুদ্ধি,
অঙ্গ
শুদ্ধি
সেরে
শুরু
হয়
পূজা-অর্চনা।
ঢাকঢোল,
শঙ্খ
ধ্বনি-উলু
ধ্বনি,
খোল-কাসাসহ
বিভিন্ন
ধরনের
বাদ্যবাজনা
বেজে
উঠবে।
আজ মহাসপ্তমী পুজোর অঙ্গই যখন কলাবউয়ের স্নান :-
শুদ্ধ ভাষায় যা নবপত্রিকা সেটাই চলিত ভাষায় পরিচিত কলাবউ রূপে৷ আর এই কলাবউ তো বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। আর এই নবপত্রিকা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল নয়টি গাছের পাতা। যদিও বাস্তবে এই নবপত্রিকা নটি পাতা নয় আসলে ৯টি গাছ। মূলত এটা কলাগাছ তার সঙ্গে থাকে কচু, বেল, হরিদ্রা (হলুদ), দাড়িম্ব (দাড়িম), অশোক, মান জয়ন্তী এবং ধান গাছ ৷ কলাগাছের সঙ্গে একেবারে মূল থেকে উৎপাটিত করে তা বেঁধে দেওয়া হয় এবং গণেশের ডান পাশেই বসানো হয় এই নবপত্রিকাকে ৷ একেই একেবারে লাল পাড় সাদা শাড়ি পড়িয়ে একেবারে ঘোমটা পড়া কলাবউয়ের রূপ দেওয়া হয় ৷ দেবী দুর্গার ছেলে মেয়ে এবং মহিষাসুরের সঙ্গে পুজো পায় এই নবপত্রিকা৷ কথিত আছে এই নবপত্রিকার ৯টি গাছ আসলে দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকস্বরূপ৷ এই নয় দেবী হলেন-রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা, দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী৷ অর্থাৎ এরাই যেন একত্রে নবদুর্গা রূপে পূজিত হয়৷
কলাবউয়ের চান দুর্গাপুজোর এক বিশেষ অঙ্গস্বরূপ৷ দেবীপক্ষের সপ্তমীর দিন সকালে কোনও নদী বা জলাশয়ে নিয়ে যাওয়া হয় নবপত্রিকাকে মহাস্নান করাতে৷ তাই সপ্তমীর দিন সকালে কলকাতায় গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে ঘাট পুরোহিতদের উপস্থিতিতে কলাবউদের নিয়ে পুজো উদ্যোক্তারা অথবা বাড়ির লোকেরা জড়ো হয়৷ পাশাপাশি চলতে থাকে ঢাকির বাজনা৷ তখনই শাস্ত্রবিধি মেনে স্নান করিয়ে নতুন শাড়ি পরানো হয় নবপত্রিকাকে ৷ তারপর তাকে ফিরিয়ে আনা হয় বাড়ির পুজোর দালান অথবা বারোয়ারি পুজোমণ্ডপে৷ সেখানে নবপত্রিকা প্রবেশের পরই দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটি প্রথাগত সূচনা হয়। এই নবপত্রিকা প্রবেশের পরই দর্পণে দেবীকে মহাস্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা প্রতিমা দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হতে থাকে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় হল, নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পূজা করা হয়।
এছাড়া মহাষ্টমী ও মহানবমীর দিনও পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে মহাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। দুর্গা প্রতিমার সামনে একটি দর্পণ বা আয়না রেখে সেই দর্পণে প্রতিফলিত প্রতিমার প্রতিবিম্বে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে স্নান করানো হয়৷ মহাস্নানের সময় শুদ্ধজল, নদীর জল, শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণ জল, সুগন্ধি জল, পঞ্চগব্য, কুশ ঘাসের দ্বারা ছেটানো জল, ফুলে দ্বারা ছেটানো জল, ফলের জল, মধু, দুধ, নারকেলের জল, আখের রস, তিল তেল, বিষ্ণু তেল, শিশিরের জল, রাজদ্বারের মাটি, চৌমাথার মাটি, বৃষশৃঙ্গমৃত্তিকা, গজদন্তমৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা, নদীর দুই তীরের মাটি, গঙ্গামাটি, সব তীর্থের মাটি, সাগরের জল, ঔষধি মেশানো জল, বৃষ্টিজল, সরস্বতী নদীর জল, পদ্মের রেণু মেশানো জল, ঝরনার জল ইত্যাদি দিয়ে দুর্গাকে স্নান করানো হয়। ধরা হয় এই সব ক্রিয়ানুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের কৃষিসম্পদ, খনিজসম্পদ, বনজসম্পদ, জলজসম্পদ, প্রাণীজসম্পদ, ভূমিসম্পদ ইত্যাদি রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানসে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়। নৈতিকতা স্থাপনে সর্বভূতে দেবীরই অধিষ্ঠানস্বরূপ পতিতোধ্বারের ভাবটিও ফুটিয়ে তোলা এই মহাস্নানের উদ্দেশ্য।
এমনকী চাষা-ভূষা, মুচি-মেথর থেকে শুরু করে ব্রাহ্মণ, মালি, কুম্ভকার, তন্তুবায়, নরসুন্দর, ঋষি, দাস প্রভৃতি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ বিশ্ব সংহতি ও বিশ্বের কাছে এক অসাম্প্রদায়িক সম্প্রদায়ের সমন্বয়বার্তা প্রেরণ করে। এককথায় সার্বিক ভাবে সমাজ কল্যাণের চিন্তা ফুটে ওঠে এই মহাস্নানে।
জীবের দুর্গতি হরণ করেন বলে তিনি দুর্গা। আবার তিনি দুর্গম নামের অসুরকে বধ করেছিলেন বলেও দুর্গা নামে পরিচিতা হন। তিনি শক্তিদায়িনী অভয়দায়িনী। যুগে যুগে বিভিন্ন সংকটের সময় তিনি মর্ত্য ধামে আবির্ভূত হয়েছেন। বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন নামে। তাই তিনি আদ্যাশক্তি, ব্রহ্মা সনাতনী দুর্গা, মহিষ মর্দিনী, কালিকা, ভারতী, অম্বিকা, গিরিজা বৈষ্ণবী, কৌমারী, বাহারী, চন্ডী লক্ষী, উমাম হৈমবতী, কমলা, শিবানী, যোগনিদ্রা নামেও পূজিতা।
দেবী মা দুর্গার কাঠামোতে জগজ্জননী দুর্গা ছাড়াও লক্ষী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ, সিংহ ও অসুরের মূর্তি থাকে। এছাড়া পেঁচা, শ্বেতহংস, ময়ূর, ইঁদুর ও সবার উপরে শিবের মূর্তি বিদ্যমান। লক্ষী ধনের, স্বরস্বতী জ্ঞানের, গণেশ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রতীক। মা দুর্গার দশটি হাত ও দশটি প্রহরণ অপরিমেয় বলবীর্যের। সিংহ বশংবদ ভক্তের ও অসুর অশুভ দুর্গতির প্রতীক। দেব সেনাপতি কার্তিক তারকাসুরকে বধ করে স্বর্গভ্রষ্ট দেবতাদের পুনরায় স্বর্গে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অতন্ত্র প্রহরায় রক্ষা করেছিলেন স্বর্গের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব।
মা দুর্গা ধরায় আসেন সন্তানদের নিয়ে। একেক সময়ে একেক বাহনে আসেন। এবার মা এসেছেন ঘোটকে