নিউ ইয়র্কের কোহিনূর যেন টাইমস স্কোয়ার, কলম্বাসের দেশ থেকে ধরিত্রীর ডায়েরির দ্বিতীয় কিস্তি

স্টাটেন আইল্যান্ড থেকে ফিরে নিউ ইয়র্কে যখন পা রাখলান তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১১টা ছুঁইছুঁই। হোটেলে ঢুকেই ফের ঝড়ের গতিতে তৈরি হয়ে নেওয়া। আসলে তখন রাতের টাইমস স্কোয়ার যে আমাদের ডাকছে।


স্টাটেন আইল্যান্ড থেকে ফিরে নিউ ইয়র্কে যখন পা রাখলান তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১১টা ছুঁইছুঁই। হোটেলে ঢুকেই ফের ঝড়ের গতিতে তৈরি হয়ে নেওয়া। আসলে তখন রাতের টাইমস স্কোয়ার যে আমাদের ডাকছে। রাত ১১.৩০টার মেট্রো ধরে পৌঁছলাম বহুল চর্চিত টাইমস স্কোয়ারে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে আবার অবাক হওয়ার পালা। কত লোক, কত আলো, কত জাঁকজমক। বিশাল বড়-বড় বিলবোর্ড, টিভি স্ক্রিন। সারাক্ষণ কোনও না কোনও সিনেমা চলছে, ফুটবল বিশ্বকাপের ম্যাচ চলছে কোনওটায়।

Advertisement

একুশ শতকের এই গ্যাজেটে ভরা টাইমস স্কোয়ারের মধ্যে এখনও যেন চুপি-চুপি খেলা করে রোমান্টিকতা। এতি-উতি কত তরুণ-তরুণী একে অপরকে রাজকীয় কায়দায় প্রেম নিবেদন করে চলেছে। কারণ, এক নাবিকের বাহুলগ্ন হয়ে থাকা তার প্রেমিকার সেই বিশ্বখ্যাত চুম্বনের ছবিটার প্রেক্ষাপট তো এই টাইমস স্কোয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাদা-কালো ছবির ক্যানভাসে গভীর আবেশের সেই চুম্বনের ছবিটি তো আজ অমরত্ব লাভ করেছে।

Advertisement

কে বলবে তখন ঘড়িতে রাত ১২.৩০? মনে হচ্ছিলো যেন দূর্গাপুজোর রাত। লোকে হেঁটে দেখছে চারপাশটা। কোনও ক্লান্তি নেই, কোনও দুঃখ নেই। সবাই মেতে উঠেছে আনন্দে, উৎসবে। রাত ২টো অব্দি সমস্ত রেস্তোরাঁ-তে লোক ভর্তি। এটা কোন দেশ ? কোথায় এলাম আমরা? পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন এখানেই আছে। জায়গাটা আমায় আপন করে নিয়েছিল। একটা অদ্ভুত সম্মোহন শক্তি রয়েছে টাইমস স্কোয়ারের। ভোর ৩.৩০-তে যখন আমরা হোটেল পৌঁছলাম, তখনও কোনও ক্লান্তি নেই শরীরে- বরং একটা অদ্ভুত ভালোলাগা যেন শরীর আর মনটাকে ভিজিয়ে রেখেছে। মনে হচ্ছে নিউ ইয়র্ক নামক শহরটা যেন তার অনামিকায় ধারণ করে রেখেছে টাইমস স্কোয়ার নামের এক কোহিনূরকে।

Advertisement

আমেরিকার দর্শনের তৃতীয় দিনের সকালে সব মজা উধাও। কারণ,যন্ত্রণায় পা-ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। প্রবল যন্ত্রণায় পা-ফেলতেই পারছি না। মনে প্রবল উৎকন্ঠা। পা-এর যন্ত্রণায় আমার ঘোরাটাই না যেন মাটি হয়ে যায়! এখনও কত কিছু দেখা বাকি! কিন্তু, সেদিন সকালটা তাই রেস্ট নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। অগত্যা হোটেলের ঘরে শুয়ে শুয়ে ডেনমার্ক-ক্রোয়েশিয়ার খেলা দেখেই সারাটা দিন কাটালাম।

বিকেলে পায়ের যন্ত্রণাটা একটু কমতেই তৈরি হয়ে নিয়েছিলাম। অর্চিস্মানের সঙ্গে পৌঁছে গেলাম সেন্ট্রাল পার্ক। ঢুকতেই আবার গা-ছমছম। এ-তো নিউ ইয়র্ক নয়! কারণ নিউ ইয়র্ক মানেই তো শুধু উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর গাড়ি। অথচ সেন্ট্রাল পার্ক নিউ ইয়র্কের চিরাপরিচিত চেহারার সঙ্গে একদমই বেমানা। বিষ্ময়ের ঘোর কাটছিল না। নিউ ইয়র্কের মধ্যে হলেও সেন্ট্রাল পার্ক পুরোটাই গাছে মোড়া। অবিশ্বাস্য !

হেঁটে ঘুরতে ঘুরতে মনে পরে যাচ্ছিলো ক্লাস এইট-এর হিস্ট্রি বই-এর কথা। তখন আমাদের পড়ানো হচ্ছে আমেরিকা সিভিল ওয়ার-এর কারণ। সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে তিলে-তিলে গড়ে উঠছিলো এই জায়গাটা। কত কিছুর সাক্ষী এই পার্ক। হাঁটতে হাঁটতে দেখি রাস্তার দু'ধারে কত লোক, কেউ গান করছে, কেউ পোর্ট্রেট আঁকছে। পৌঁছলাম পার্ক-এর একটা ঝর্ণার ধারে। আর আবার আনন্দে লাফানোর পালা,কারণ শাহরুখ! এখানেও তো 'কাল হো না হো' ছবির শ্যুটিং হয়েছিল। পার্কে ঘন্টা দুয়েক কাটানোর পর আমরা খেয়ে-দেয়ে হোটেল পৌঁছলাম।

Advertisement

আমেরিকা-তে এসে আমি প্রথম খেয়েছিলাম চিজ কেক । আর এরপর প্রেমে পরে গিয়েছিলাম এই অদ্ভুত খাবারের। কতবার- কত রকম ভাবে চেষ্টা করেছি বাড়িতে বানানোর, কোনও দিনই কেকটাকে বাগে আনতে পারি নি। তাই চতুর্থ দিন আমরা গেলাম নিউ ইয়র্ক এর সেরা চিজ কেক খেতে। পর-পর চারটে কেক খেয়ে আর ঠিক কতটা মোটা হলাম এই সমস্ত ভাবনা নিয়ে পৌঁছলাম এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং।

Advertisement

নিউ ইয়র্ক শহরের ডাক নাম 'এম্পায়ার স্টেট'। সেখান থেকেই এর নাম হয়েছে এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং। টিকিট কেটে ঢুকলাম গগনচুম্বী ইমারতের ভেতর। ১৯৩১ থেকে ১৯৭০ অব্দি এটি ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ ইমারত। বর্তমানে এটি আমেরিকার পঞ্চম সর্বোচ্চ ইমারত। ৮৬ তলায় গিয়ে পুরো নিউ ইয়র্ক শহরটা-কে চাক্ষুষ করলাম। আকাশকে এ-তো কাছ থেকে কোনও দিনই দেখিনি।

এ-তো উঁচু-উঁচু বাড়ি তখন কত ছোট লাগছিলো চোখের সামনে। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি গাড়িগুলো ঠিক যেন ব্যাটারী চালিত খেলনা গাড়িগুলোর মতো ছুটে যাচ্ছে। দেখলাম বিল্ডিংগুলো আস্তে-আস্তে আলোকিত হচ্ছে আর সূর্যীমামা অন্যদিকে অস্ত যাচ্ছে। সেই যা দৃশ্য তা অবর্ণনীয়। কোনও ভাষাতেই তাকে বর্ণনা করা যায় না। মৃদু হাওয়া আর সূর্যাস্ত,সে এক অদ্ভুত সমাহার।

Advertisement


পঞ্চম দিন, আমরা লিবার্টি লেডি-কে আরো কাছ থেকে দেখবো বলে ফেরি করে পৌঁছলাম লিবার্টি আইল্যান্ড। লম্বা লাইন আর কড়া নিরাপত্তা পেরিয়ে আমরা অবশেষে পৌঁছলাম স্ট্যাচু অফ লিবার্টির কাছে। এই বিপুলাকায় ভাস্কর্য দেখার পর এক অদ্ভুত অনুভূতি গ্রাস করলো আমায়। ছোটবেলায় পড়েছিলাম রোমানদেবীর আদলে তৈরি এই ভাস্কর্য নাকি ফ্রেঞ্চরা উপহার স্বরূপ দিয়েছিলো আমেরিকাকে। এর ডান হাতে একটি টর্চ এবং বাম হাতে একটি বই যাতে রোমান অক্ষরে লেখা জুলাই ৪ঠা ১৭৭৬। এই দিন আমেরিকা মুক্তি পেয়েছিলো ব্রিটিশ রাজত্ত্ব থেকে। হালকা সবুজ রঙের এই ভাস্কর্য আজও জানান দিচ্ছে কত স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা।


এবার ঘরে ফেরার পালা। ৫ দিনে শহর টা খুব নিজের লাগছিলো,খুব-ই আপন। এত কষ্ট হবে ভাবতেও পারিনি। এই-তো এলাম, এখুনি চলে যাবো? অনেক স্মৃতি নিয়ে শার্লট- এ নামলাম। জীবন যেন কিরকম সার্থক মনে হচ্ছিল। কিন্তু এখনও কত কিছু দেখা বাকি- কত আনন্দে আত্মহারা হওয়া বাকি! কত পথ চলা বাকি। এখনও আমার স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার-টাও যে দেখা বাকি। তাই ফের ফিঙ্গার ক্রসড--- মনে মনে শুরু ঘুরচক্করের কাউন্ট-ডাউন...।

(আরও পড়ুন- কলম্বাসের দেশে ধরিত্রী, স্বপ্ন-ডানায় আবেশ মেলল আবেগ, বাঙালি বধূর কলমে এক অসামান্য ডায়েরি)

English Summary

Dharitri Gamgully was spending her holiday in New York. After wondering through the streets of New York Dharitri was overwhelmed with joy.