শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো: কামানের তোপও নেই, ওড়ে না নীলকণ্ঠ পাখিও, তবু ভাটা পড়েনি সাবেকিয়ানায়
এককালে কামানের তোপ দেগে শুরু হত শোভাবাজার রাজবাড়ির সন্ধিপুজো। সমাপ্তিও হত কামানের গোলার শব্দে। এখন আর সেই রামও নেই, সেই রাজত্বও নেই। কিন্তু চিরাচরিত প্রথার অন্যথা ঘটে কী করে! তাই অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে এখনও চিরাচরিত প্রথা মেনে বন্দুকের গুলির শব্দ করা হয়৷ রাজবাড়ির বিশ্বাস, ওই সন্ধিক্ষণে মা দুর্গা ত্রিশূল দিয়ে অসুর বধ করেন। তখনই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটে, জাগ্রত হয় শুভ শক্তি৷ অশুভ শক্তির বিনাশে ওই শব্দের দ্বারা প্রতিধ্বনিত হয় মর্ত্যবাসীর জয়োল্লাস।
তেমনই চিরাচরিত রীতি মেনে নীলকণ্ঠ পাখি ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ ছিল বিসর্জনের আগে। এখন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন লাগু হওয়ায় নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে রাজবাড়ির দুর্গাপুজোতে৷ তবে রীতি অনুযায়ী এখন মাটির তৈরি নীলকণ্ঠ পাখি গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়৷ প্রচলিত বিশ্বাস থেকেই আজও অব্যাহত এই ধারা। বিশ্বাস ছিল, এই নীলকণ্ঠ পাখি কৈলাসে মহাদেবকে মায়ের রওনা হওয়ার খবর দেয়৷ সেই বিশ্বাসকে পাথেয় করেই আজও বর্তমান সমস্ত সাবেকিয়ানা।
শোভাবাজার রাজবাড়ির এই পুজোর প্রতিষ্ঠাতা রাজা নবকৃষ্ণ দেব৷ ব্রিটিশ আমলে প্রথম এ দেশীয় বিচারক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট সুনাম ছিল। তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বলেও কথিত আছে। সেই সূত্রেই তাঁর রাজা উপাধি পাওয়া। রাজা নবকৃষ্ণ দেব শোভাবাজার রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোর শুরু করেন ১৭৫৭ সালে৷ লর্ড ক্লাইভ থেকে লর্ড হেস্টিংসের মতো ব্রিটিশ শাসকরা এসেছিলেন এই রাজবাড়ির পুজোয়। এমনকী রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর, গান্ধীজির মতো মনীষীদেরও পদধূলি পড়েছিল এই রাজবাড়িতে৷ রাজা নবকৃষ্ণ দেবের মৃত্যুর পর শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে ঠিকই, তবে যে নিয়ম, আচার-অনুষ্ঠানে বাঁধা ছিল রাজবাড়ির পুজো, আজও তা চিরাচরিত ধারা অনুযায়ী বহমান।
সেই উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো হয়। তারপর থেকে বাড়িতেই প্রতিমা নির্মাণ শুরু৷ উত্তর কলকাতার এই রাজবাড়িতে কৃষ্ণা নবমী তিথিতে বোধন হয়৷ ঠাকুর দালানে বেদি করে দেবীর ঘট স্থাপন করা হয়৷ সেদিন থেকেই চলে চণ্ডীপাঠ, বেদ, রামায়ণ পাঠ। এই বাড়ির পুজোয় কোনও অন্নভোগ হয় না৷ চাল, কলা দিয়ে নৈবেদ্য নিবেদন হয়৷ বাড়ির তৈরি প্রায় ৩৩ রকমের মিঠাই ভোগ মাকে নিবেদন করা হয়৷ ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় বেলগাছের তলায় বরণ, আমন্ত্রণ, অধিবাস হয়৷ তারপর প্রতিমার সামনে ঘট স্থাপন ও প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ দেবী দুর্গাকে সোনার নথ ও সিঁদুর পরানোও হয় ওইদিন৷ সপ্তমীতে ভোরে রাজবাড়ির নিজস্ব ঘাটে নবপত্রিকা স্নান ও মহাস্নানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেবী আরাধনা।
শোভাবাজার রাজবাড়ির রীতি অনুযায়ী দশমীর দিন সকালেই বিজয়া হয়৷ বিষাদের সুর বেজে ওঠে সানাইয়ে৷ বিকেলে শোভাযাত্রা করে গঙ্গায় প্রতিমা নিরঞ্জন। এই রাজবাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জনের দৃশ্যটি অভূতপূর্ব৷ দুটি নৌকার মাঝে প্রতিমা রাখা হয়। মাঝনদীতে পৌঁছে নৌকা দু'টি ধীরে ধীরে সরে গেলে মাতৃমূর্তি ভেসে যায় বিজয়ায়। নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়ার সেই রেওয়াজ বন্ধ হলেও রীতি অনুযায়ী প্রতিমা নৌকায় ওঠার সঙ্গেই সঙ্গেই মাটির তৈরি নীলকণ্ঠ পাখি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয় এখনও৷