ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি নিয়ে পুজো আসে বৃদ্ধাশ্রমে
ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি নিয়ে পুজো আসে, আবার চলেও যায় ওঁদের জীবনে। একদিকে জীবনের খ্যাতি, যশ, প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে ব্যাকুল অব্যক্ত প্রতীক্ষা। বিস্তর ফারাক জীবনের দুই অধ্যায়ের। দু'টি পৃথিবীই আলাদা। তাই জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধাশ্রমে থেকেই পুজো কাটান আবাসিকরা। সব থেকেও সব হারানোর বেদনা আছে ঠিকই, কিন্তু সেইসঙ্গে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বৃদ্ধাশ্রমকেই নতুন সংসার মেনে নিয়েছেন। তাই এখানকার মতো করেই পুজো উপভোগ করতেই তাঁরা অভ্যস্ত। আর বাড়ি ফেরার 'স্বপ্ন' দেখেন না তাঁরা।
কলকাতার নবদিগন্ত হোক বা হাওড়ার পাঁচরুলের ভিলেজ ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি। কিংবা হুগলির কল্যাণভারতী বা মেদিনীপুরের মিলন তীর্থ, সব বৃদ্ধাশ্রমের চিত্রটাই এক। বৃদ্ধাশ্রমকেই বাড়ি বানিয়েছেন আবাসিকরা। কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, মেদিনীপুর কিংবা অন্য জেলা থেকে সংসার ছেড়ে তাঁরা দিন কাটাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। সংসারে তাঁদের ঠাঁই নেই। অনেকেরই ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার ছিল। কিন্তু তাতে আর কী এসে যায় এখন। ব্যর্ধক্য আসার পরই সংসারে ব্রাত্য তাঁরা। কেউ আবার বাল্য বিধবা।
আপনজন বলতে কোনও কুলে কেউ নেই। আবার কেউ অবিবাহিত। বৃদ্ধাশ্রমে এসে তাঁরা পেয়েছেন সংসারের স্বাদ। কিন্তু পুজো এলে তো মন খারাপ করেই। মনে পড়ে আপনজনের কথা যাঁদের কেউ নেই তাঁরাও মনে ভাবেন, আমারও যদি কেউ থাকত, পুজো কাটত অন্যভাবে। বৃদ্ধাশ্রমের দায়িত্ব থাকা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের মুখেও সার কথা, আত্মীয়স্বজনরা খুব কম আবাসিকেরই খোঁজ খবর রাখেন। তবে অনেক পরিবারের তরফে নতুন পোশাক পরিচ্ছদ আসে। আবার অনেকে সেই স্বাদটুকুও পায় না। অনেক ক্ষেত্রেই আবাসিকদের নতুন পোশাকের স্বাদ দেয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি।
কেউ কেউ অবশ্য বাড়িও ফেরেন। তবে সেই সংখ্যাটা নগণ্যই। বাঁশদ্রোণীর ঝর্না চট্টোপাধ্যায় বা শিবপুরের করুণাময়ী দাসদের ভরা সংসার ছিল। তবু জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধাশ্রমকে মেনে নিতে হয়েছে নতুন সংসার বলে। হুগলির লাবণ্যপ্রভা ঘোষ বা কলকাতার মৃদুলা চক্রবর্তী, কালীঘাটের নীলা বন্দ্যোপাধ্যায়রা বৃদ্ধাশ্রমে থেকেই উপভোগ করবেন শারদ উৎসব। প্রতি বছরই আশ্রমের তরফে আবাসিকদের পুজো দেখতে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ। গাড়ি ভাড়া করে শারীরিক সক্ষম আবাসিকরা যান পুজো দেখতে।
পুজো ক'দিন একটু অন্যরকম কাটে। অন্যদিনের তুলনায় এই দিনগুলো আলাদা মাত্রা পায় আবাসিকদের কাছে। আবাসিকদের কথায়, আসলে থাকতে থাকতে এই বৃদ্ধাশ্রমই তাঁদের কাছে সংসার হয়ে গিয়েছে। আমরা আবাসিকরা প্রত্যেকেই সেই সংসারের সদস্য। যা কিছু ভালোমন্দ সব নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিই। অনেকে বলেন, এটাই হয়তো ভাল হয়েছে। সংসারে থাকলে আমাদের মতো বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা হয়তো অপাংক্তেয়, অবাঞ্ছিত থাকতেন। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে তাঁরা কেউই ব্রাত্য নন। নিজের মতো করে নতুন ভাবনায় এই সংসার তাঁরা সাজিয়ে তুলেছেন।