বাবুদের শখের পুজোর প্রতিবাদে শুরু হওয়া দীনদুখিনী টুকির মায়ের পুজো এখনও স্বমহিমায়
বাবুদের শখের জীবন, অহঙ্কারের বাহুল্য, শোষণ আর ঔদ্ধত্যে অতিষ্ঠ হয়ে দীনদুখিনী টুকির মা নিজের ভিটেতেই আবাহন করেছিলেন দেবী দুর্গার। দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে 'মহাসমারোহে' সেই পুজোর আয়োজন করতেন উদয়নারায়ণপুরের ভবানীপুরের বাসিন্দা ওই ধাত্রী মা। দেবীর স্বপ্নাদেশেই এই পুজোর প্রধান উপাচার ছিল 'গব্যথোড়' আর 'কুঁড়ো'র নৈবেদ্য।
যা এখনও সন্ধিপুজোর সময় নৈবেদ্যাকারে দেওয়াই রীতি। কালের নিয়মে টুকির মায়ের পুজো ভবানীপুর সর্বজনীন দুর্গোৎসবে রূপ পেলেও তাঁর বংশধররাই এখনও সন্ধিপুজোয় গব্যথোড় আর কুঁড়োর নৈবেদ্য সাজিয়ে দিয়ে যান। আড়াইশো বছর ধরেই এই রীতি চলে আসছে উদয়নারায়ণপুরের টুকির মায়ের দুর্গাপুজোয়।
বাংলায় দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল রাজা-মহারাজা-জমিদার- ভুস্বামীদের হাত ধরে। দালান-দেউলে এই দুর্গাপুজোর মধ্য দিয়েই প্রকাশ করা হত রাজবাড়ির অহঙ্কারের বাহুল্য। কাঙালি ভোজনের সঙ্গে বাঈজিদের নাচ-গান তো ছিলই, পুজোর অন্যান্য আড়ম্বরের সঙ্গে ঝাড়বাতির নিচে জমা করা হত অন্ধকারের রসদ। যা একেবারেই পছন্দ হয়নি দীনদুখিনী টুকির মায়ের। প্রতিবাদ করার ভাষা ছিল না। তখনই তিনি স্থির করেছিলেন রাজবাড়ির এই ঔদ্ধত্যের তিনি জবাব দেবেন দুর্গাপুজোর আয়োজন করে।
বিলাসবহুল আয়োজনে উপলক্ষের দুর্গা আরাধনা নয়, সেই পুজো হবে নিষ্ঠা সহকারে ভক্তি-অর্চনা। নিম্নবর্গীয় হরিজন সম্প্রদায়ের এই ধাত্রী মা সেইমতো আনুমানিক আড়াইশো বছর আগে শুরু করেছিলেন দুর্গাপুজো। ভবানীপুরের নিজের বসতবাটিতেই তিনি সেই সাধনা সার্থক করে তুলেছিলেন। বহু যুগ আগে তিনি গত হলেও তাঁর হাত দিয়ে গ্রামের যেসব সন্তান পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন তাঁরাই এবং তাঁদের বংশধররা পালন করে আসছেন সেই পুজোর পরম্পরা।
গ্রামের অতিদরিদ্র এই টুকির মায়ের নাম জানা যায়নি। তবে জনশ্রুতি রয়েছে, তাঁর পদবী ছিল মণ্ডল। ভবানীপুর, সোনাতলা, বারাসাত, গড়ভবানীপুর, চিত্রসেনপুর গ্রামে ধাত্রীমায়ের কাজ করেই তাঁর দিন চলত। তখনই তিনি বিভিন্ন রাজবাড়ি, জমিদার বাড়িতে ঘুরে দেখেছেন কী 'নোংরা' ছিল সেই মানুষের রুচি। প্রতিবাদে শক্তিরূপী দেবী দুর্গাকে আবাহন করার মাধ্যমে তিনি সমগ্র নারীজাতির জাগরণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সম্বল বলতে ছিল নিজের ভিটেটুকু। পুজোর উপচার সংগ্রহ করতে তিনি মানুষের দোরে দোরে ঘুরেছেন। তখনই স্বপ্নাদিষ্ট হয়েছিলেন কিছু না পেলে গব্যথোড় আর কুঁড়ো দিয়ে পুজো করার। তিনি মারা যাওয়ার পর টুকি কিছুদিন এই পুজো চালিয়েছিলেন।
এরই মধ্যে ভিটে খুইয়ে তাঁর স্থান হয়েছিল শশীভূষণ চৌধুরী নামে এক হিতাকাংক্ষীর ডাঙায়। এরপর কিছুদিন পশুপতি দাসের উদ্যোগে পুজো চলে। মাঝখানে কিছুদিন বন্ধও হয়ে যায় পুজো। তারপরই ভবানীপুরের চক্রবর্তীপাড়া, দাসপাড়ার বাসিন্দারা সংগঠিত হয়ে পুজো চালানোর উদ্যোগ নেন। টুকির মায়ের সম্মান, মর্যাদা ও স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে এখন উদ্যোগী ভবানীপুর সর্বজনীন।