মমতার সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে বিমল গুরুং এখন রীতিমতো বিপাকে; নেত্রীর উপ-আঞ্চলিক শত্রুরা একে একে নতিস্বীকার করছেন?
দার্জিলিং-এর রাজনীতি ইদানিং আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আর পাঁচ বছর আগের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা টানলে তো পাহাড়ের রাজনৈতিক অবস্থা এখন বলতে হয়, সম্পূর্ণ বিপরীতে। এর অন্যতম কারণ: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নেতা বিমল গুরুং-এর ব্যক্তিত্বের সংঘাত।
কিন্তু এই সংঘাতে গুরুং কতদিন টিকে থাকতে পারবেন, সে-ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এর আগে বাম নেতা জ্যোতি বসুর জমানায় সিপিএম প্রয়াত জিএনএলএফ নেতা সুবাস ঘিসিং-এর সঙ্গে সমঝোতার রাস্তায় গিয়ে পাহাড়ে বছরের পর বছর কর্তৃত্ব বজায় রাখত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম দিকে গুরুং-এর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখলেও 'সহাবস্থানের' রাজনীতিতে আগ্রহ দেখাননি। নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বারেবারে ছুটে গিয়েছেন এবং এখনও যাচ্ছেন পাহাড়ের মানুষের কাছে। আর এতেই পায়ের তলায় জমি দ্রুত হারাচ্ছেন গুরুং।
মোর্চা সুপ্রিমোর অবস্থা এখন যে এখন বেশ টলমল তা তাঁর বারংবার হুঙ্কারেই বোঝা যাচ্ছে। বুধবার (সেপ্টম্বর ২৯) মমতা সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গুরুং পাহাড়ে বারো ঘন্টার বনধ ডেকেছেন, কিন্তু তা কতটা সফল হবে তা নিয়ে সন্দিহান স্বয়ং গুরুং-এর দলই। কারণ আর কিছুই নয়, একপেশে বনধ-এর রাজনীতি করতে করতে গুরুং যেমন তাঁর রাজনৈতিক ধার হারিয়েছেন; অন্যদিকে, মমতার তৃণমূল এখন পাহাড়ে এক নতুন শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।
হরকাবাহাদুর ছেত্রী তো মোর্চা ছেড়ে তৃণমূলে আগেই গিয়েছিলেন, সম্প্রতি কালিম্পঙ-এ হাজার হাজার মোর্চা কর্মীও শাসকদলে যোগদান করে। এই পরিস্থিতিতে মমতাকে তাঁর পাহাড়ের উন্নতি খাতে ৪,০০০ কোটি টাকা খরচ করার দাবিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গুরুং পাল্টা আক্রমণের পথ বেছে নিলেও ২০১৬ সালের তৃণমূল প্রধানকে তাতে কতটা দমানো যাবে, তা সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
ঠিক পুজোর মুখে গুরুং-এর এই একরোখা বনধ হয়তো তাঁর রাজনৈতিক যাত্রাকেও শেষ করে দিতে পারে কিন্তু কোনঠাসা এই মোর্চা নেতার কাছে এছাড়া আর উপায়ই বা কী ছিল, অন্তত এখন? গুরুং-এর আগেই বোঝা উচিত ছিল যে হুমকি-হুমকির রাজনীতি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারানো তাঁর মতো উপ-আঞ্চলিক নেতার পক্ষে অসম্ভব। যদি তিনি সংঘাতের রাস্তায় না গিয়ে নবান্নর সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলতেন, যেমনটি তিনি প্রথমে শুরুও করেছিলেন, তাতে লাভবান হতেন লম্বা দৌড়ে। কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হতে গিয়েই গুরুং প্রায় ডুবেছেন।
দিনের পর দিন পাহাড়ে অচলাবস্থা রেখে মোর্চা আসলে নিজেদের সর্বনাশ নিজেরাই ডেকে এনেছে। পূর্ববর্তী বাম সরকারের মতো পাহাড়ের প্রতি উদাসীন নীতি থাকলেও না হয় এই অচলাবস্থার রাজনীতি চলত কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পূর্ণ অন্য ধাতুতে তৈরী। বিমল গুরুং সেটা বুঝতে বুঝতেই খেলা তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।
ধূর্ত তৃণমূল নেত্রী গুরুংকে বেকায়দায় ফেলতে পাহাড়ের অন্যান্য জনজাতিদের গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের স্বাদ দিয়ে মোর্চার গুরুত্ব একধাপে অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছেন। আর এখন এই নিয়ে গুরুং যত কাঁদুনি গাইবেন, ততই মুখ্যমন্ত্রীর হাত শক্ত হবে, কারণ অন্যান্য জনজাতির নেতৃত্ব গুরুংকে তাঁদের শত্রু হিসেবেই দেখবেন।
অথচ এই গুরুংই যদি নিজেদের বৃহত্তর লাভের কথা ভেবে আরেকটু আপোস করতেন রাজনৈতিকভাবে, আজ এই নাকানিচোবানি খেতে হত না। এই বছরের নির্বাচনেই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার হতাশাজনক ফলাফলই বুঝিয়ে দিয়েছে পাহাড়ের জনমানসে গুরুং-এর পতনের কথা। দার্জিলিং-এ আসন্ন পুর নির্বাচন তাই এখন গুরুং এবং তাঁর দলের কাছে রীতিমতো অগ্নিপরীক্ষা।
আর গুরুং-এর কাছে আরও খারাপ খবর হচ্ছে পাহাড় সম্বন্ধে এখন বিজেপির অপেক্ষাকৃতভাবে চুপ হয়ে যাওয়া। কারণ বোঝা দুর্বোধ্য নয়। কেন্দ্রে শাসনে থাকার ফলে এখন বিজেপিকে এখন অনেক দায়িত্বশীল হতে হয়েছে। চীন সীমান্তের কাছে গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের সমর্থন যোগান তার পক্ষে এখন কোনওভাবেই সম্ভব নয়, অন্তত প্রতীকী অর্থেও।
পশ্চিমবঙ্গে এখন বাম এবং কংগ্রেসেরও রাহুর দশা চলছে। এই অবস্থায় গুরুং-এর কোনও বিকল্পই আর নেইএই অবস্থায় গুরুং-এর কোনও বন্ধুই আর অবশিষ্ট নেই।
অধীর ডুবেছেন, এবার বোধহয় গুরুংও ডুববেন
অবশ্য বিকল্পের অভাবে শুধু যে উনি ভুগছেন তা নয়। রাজ্যে কংগ্রেসের সবচেয়ে শক্তিশালী যে ঘাঁটি, সেই মুর্শিদাবাদেও মমতার দল এখন কর্তৃত্বে। অবিশ্বাস্য ঠেকলেও অধীররঞ্জন চৌধুরীর মতো কংগ্রেসের দুঁদে নেতাও এখন প্রায় গৃহহারা।
তেমনই বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া তৃণমূলে যোগ দেওয়াতে পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং-ও কংগ্রেস ক্ষয়িষ্ণু। আর বামেদের দেখতে গেলে তো এখন শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র কেনা দরকার। সুতরাং বলা চলে, প্রধান প্রতিপক্ষ বামেদের তো বটেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আস্তে আস্তে অধীর বা গুরুং-এর মতো উপ-আঞ্চলিক নেতাদেরও প্রায় পথে বসিয়েছেন (উত্তর দিনাজপুরের দাশমুন্সিদেরও একইভাবে জমি হারাতে হয়েছিল ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে)।