যাঁদের হাতে পৃথিবীর আলো দেখে শিশুরা, তাঁরাই পাচারের চাঁই, ব্যর্থতা এড়াতে পারে না রাজ্য
এর আগে কিডনি পাচারের ভয়ানক চিত্র সামনে এসেছিল রাজ্যে। তাতেও নামি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ওজনদার চিকিৎসকদের নাম জড়িয়েছিল।
মানুষ কত নিচে নামতে পারে শিশু পচার চক্র সামনে আসায় তা আর একবার স্পষ্ট হল। এবার পাচারকারীদের তালিকায় যুক্ত হলেন চিকিৎসক, নার্সিংহোম মালিক, সরকারি বেসরকারি হোম কর্তা, নার্স ও আয়ারাও। একজন মাকে সুস্থ সন্তান নিয়ে বাড়ি ফেরার আশায় তাঁদের শরণাপন্ন হতে হয়। তাঁরাই যে বদলে দিচ্ছেন শিশু পরিচয়। রাজ্যে জাল ছড়িয়ে পড়ায় আশঙ্কার আঁধার গ্রাস করেছে মায়েদের মন।
এর আগে কিডনি পাচারের ভয়ানক চিত্র সামনে এসেছিল রাজ্যে। তাতেও নামি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও ওজনদার চিকিৎসকদের নাম জড়িয়েছিল। তারপরও রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর চিকিৎসা পরিষেবার প্রতি কড়া নজরদারি চালায়নি। তারই ফল আজকের এই শিশু পাচার ও বিক্রির চক্র। রাজ্য যদি শক্ত হাতে লাগাম ধরত, তাহলে শিশু পাচার চক্রের এই বাড়বাড়ন্ত হতে পারত না।
গত মঙ্গলবার হাইকোর্ট শিশু পাচারকাণ্ডে হলফনামা পেশ করার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্যকে। আর তারপরই নড়েচড়ে বসেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। দীর্ঘ বছর ধরে বিশাল নেট ওয়ার্কের মাধ্যমে রাজ্যে শিশু পাচার চলছে অথচ পুলিশ তা জানতেই পারেনি, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? শিশু পাচার চক্রে শাসকদলের কারও যোগ আছে বলেই কি পুলিশ প্রশাসন চুপ ছিল? এ প্রশ্নও উঠে পড়েছে।
এই এক সপ্তাহের মধ্যে বাদুড়িয়ার নার্সিংহোম থেকে তিনটি ও ঠাকুরপুকুরের মানসিক প্রতিবন্ধীদের আশ্রম থেকে ১০ জন শিশুকে উদ্ধার করা হয়। তারপর জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই একটা না একটা শিশু উদ্ধার হচ্ছে। প্রশাসনের ভয়ে ফেলে চলে যাচ্ছে শিশুদের। আরও ভয়ানক ঘটনার সাক্ষী মছলন্দপুর। সেখানে মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেছে দুই শিশুর হাড়গোড়।
জানা গেছে মূলত মফস্বলের কিছু আইনি কিছু বেআইনি নার্সিংহোমে এসব হয়। প্রসবের পর সন্তান মারা গেছে বলে জানানো হয়। তারপর সেই শিশুকে পাচার করা হয় বিস্কুটের বাক্সে। তাদের বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত রাখা হয় অপরিচ্ছন্ন বদ্ধ ঘরে। মশা তাড়াতে ঘরে জ্বালানো হত কয়েল বা ডিমের ট্রে? যার বিষাক্ত ধোঁয়া সদ্যজাতদের কাছে ভয়ংকর বিষ। এও জানা যাচ্ছে শিশুদের দ্রুত শরীর বৃদ্ধির জন্য বিশেষ ধরনের হরমোন প্রয়োগ করা হত। ফলে তিন চার মাসের শিশুর চোখ-মুখ বিকৃত আকার নেয়।
সূত্রপাত উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোম। সেখান থেকে ঘটনা সরে আসে কলকাতার পূর্বাশা নার্সিংহোম। তারপর প্রকাশ্যে আসে বর্ধমান, কোচবিহার, মেদিনীপুর। পাচারচক্রের পাণ্ডা বিমল অধিকারী কোন এলাকার মানুষ তা এখনও স্পষ্ট নয়। শুধু নার্সিংহোম নয়, স্পষ্ট হয়েছে শিশু পাচারের মতো জঘন্য কাজে যোগ রয়েছে কয়েকটা বৃদ্ধাশ্রম ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
দেশে অপুত্রক দম্পতিদের জন্য দত্তক নেওয়ার আইনি পথ রয়েছে। সেটা কিছুটা সময়সাপেক্ষ এবং আদালতে হাজির হতে হয় বলে অনেক ঘুরপথে সহজে টাকার বিনিময়ে শিশু কেনার পথে হাঁটেন। উন্নত দেশগুলোতেও শিশুর চাহিদা এবং বাড়ির পরিচারক পরিচারিকার প্রয়োজন রয়েছে অধিক। কিছু টাকায় এমন শিশু কিনে নিতে পারলেই কেল্লাফতে। তাই শিশু পাচারের ব্যবসা এত রমরমা। হাহকোর্টের চড়া সুর লক্ষ্য করে রাজ্য সরকার তড়িঘড়ি বৈঠক করে কঠোর হওয়ার বার্তা দিয়েছে।
সিদ্ধান্ত হয়েছে, বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলিতে সারপ্রাইজ ভিজিট চলবে। একই সঙ্গে হোম ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর প্রতিও নজরদারি চলবে। দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও কঠোর হবে আইন। আরও খোঁজখবর নেওয়া হবে পরিবার সম্বন্ধে। দত্তকে আগ্রহীদের যাবতীয় নথিপত্র আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে হবে। দত্তক নেওয়ার পরও নজরদারি চলবে। সেই শিশু গৃহে পালিত হচ্ছে নাকি পাচার হয়ে গেছে, তাও খতিয়ে দেখা হবে।
সিআইডি তদন্ত করছে। সল্টলেকের নামজাদা এক গাইনোকলজিস্টকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল দু'দিন ধরে। তারপর গ্রেফতার করা হল। একইদিনে গ্রেফতার হল বেহালার আরও এক শিশু বিশেষজ্ঞ। শিশুপাচার কাণ্ডে রাজ্য সরকারের নানা ব্যর্থতা ও দীর্ঘসূত্রিতা সামনে আসছে।
যেমন জোকার বৃদ্ধাশ্রমের নথি চেয়ে রাজ্য সরকার কয়েকবার ব্যর্থ হয়েছে। তারপরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওখানেও মিলছে কয়েকটা শিশু। নানারকম হাস্যকর সাফাই গেয়ে এড়িয়ে গেছেন নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা। এমন বহু অসঙ্গতি সামনে আসছে। তাই ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা পিছনে শাসকদলের যোগ পেলে সিআইডি জঘন্য এই অপরাধ কাণ্ডকে গুলিয়ে দেবে না তো?