মোদী প্রথম নন, ২০০২ সালে বাজপেয়ির সময়েও ভারত-পাক যুদ্ধ প্রায় লেগে গিয়েছিল
ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কের এই প্রবল তিক্ততার মধ্যে প্রাক্তন পাকিস্তানী ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াঁদাদ একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে এই সময় তাঁর অটলবিহারী বাজপেয়ির কথা মনে পড়ছে। স্পষ্টভাষী মিয়াঁদাদের কোথায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনার সুর ছিল স্পষ্ট। উনি মোদীকে ক্রিকেটের মাধ্যমে শান্তির বাতাবরণ তৈরীর প্রচেষ্টারও পরামর্শ দেন।
কিন্তু মিয়াঁদাদ বোধহয় ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট নিয়ে যতটা খবর রাখেন, ততটা দু'দেশের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক সম্পৰ্ক নিয়ে রাখেন না। জানলে, বাজপেয়ির সম্পর্কে এই কথাটি বলতেন না। [দলিত, পাকিস্তান, মুসলমান - এতদিক সামলাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বেশ বিব্রতই মনে হচ্ছে]
ভারতের সংসদ ভবনে জঙ্গিহানা হওয়ার পরেই সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে
কারণ জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০০১ সালের ১৩ই ডিসেম্বরে, যেদিন ভারতের গণতন্ত্রের পীঠস্থান সংসদ ভবনে ঘটে যায় এক জঙ্গিহানা। পাঁচজন সশস্ত্র লোক সংসদে আক্রমণ করে। সেদিন দলমতনির্বিশেষে ভারতের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুছে সাফ হয়ে যেতে পারত যদি ওই পাঁচজন সংসদের ভিতরে কোনওভাবে ঢুকে পড়ত। কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে তা হতে দেয়নি সেদিন। মারা পড়েছিলেন সংসদের এক মালীও।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১-র কয়েকমাস পরেই হওয়া এই ভয়ঙ্কর কাণ্ডের পর প্রশ্নের মুখে পরে তৎকালীন বাজপেয়ী সরকারের নিরাপত্তানীতি। বাজপেয়ী সরকারও অবশ্য চুপ থাকেনি। ওই পাঁচজন জঙ্গির পাকিস্তান-যোগাযোগের কথা জনসমক্ষে আসতেই বিজেপি-নেতৃত্বাধীন সরকার ইসলামাবাদের প্রতি এক কড়া অবস্থান নেয়। ডিসেম্বর ওই জঙ্গিহানার পরবর্তী সময়ে ভারত এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণরেখার দু'পারে বিপুল সৈন্য মোতায়েন কড়া শুরু করে এবং দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে এই উত্তপ্ততা চিন্তায় ফেলে সারা দুনিয়াকে।
কালুচকে জঙ্গিরা ৩১ জনকে হত্যা করে
দশ মাস ধরে চলে এই অচলাবস্থা। বিশেষ করে ২০০২ সালের ১৪ই মে জম্মু-কাশ্মীরের কালুচকে তিন সশস্ত্র জঙ্গির হাতে ৩১ জন নিহত হওয়ার ঘটনার পর অবস্থার আরও অবনতি হয়। কার্গিলের সংঘর্ষের পর এই দুই দেশ যুদ্ধের এত কাছে এই প্রথম আসে।
সীমান্তে বিপুল সেনা মোতায়েন হয়, কিন্তু যুদ্ধ লাগেনি
আজকে যাঁরা মোদীকে দেখে হতাশ তাঁদের জেনে রাখা ভাল যে ২০০২ সালে বাজপেয়ী সরকারও কিন্তু পরমাণু-শক্তিধর পাকিস্তানকে কিছু করতে পারেনি, কালুচকের ওই হত্যাকাণ্ডের পরেও। ১৯৯৮ সালে পরমাণু শক্তি আয়ত্ত্ব করার পরে পাকিস্তানের কাশ্মীর প্রসঙ্গে মনোভাব আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছে কিন্তু ভারতের প্রতিরক্ষানীতি সেভাবে বিবর্তিত হয়নি। আজকে মোদীও তাঁর পূর্বসূরির মতো পাকিস্তানকে সামলানোর কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। না পাওয়ারই কথা। ভারতকে এবার যুদ্ধের বাইরে কিছু ভাবতে হবে। [দোহাই, এই যুদ্ধের জিগির এবার বন্ধ করুন! পাকিস্তান ছাড়াও আমাদের অনেক কিছু ভাবার, করার আছে]
নয়াদিল্লির পাকিস্তান-নীতির এখন একটিই দিশা হতে পারে - নিজের সীমানা এবং সৈন্যদের প্রতিরক্ষা মজবুত করা। পাকিস্তানকে হেলাফেলা করা এখন মূর্খামি ছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা সেনানায়ক এবং কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ভালোই জানেন। কিন্তু ভোট-ভীত রাজনৈতিক নেতারা পুরোনো বুলি কপচাতেই থাকেন যাতে জনগণ মুখ ফিরিয়ে না নেয়। কিন্তু বাস্তবকে অস্বীকার করে রাজনীতি হয় না। আজ যদি ইন্দিরা গান্ধীও ক্ষমতায় থাকতেন, তিনিও মোদীর মতোই পথ খুঁজতেন। ১৯৭১ অন্য দুনিয়া ছিল। আর আর সেকথা ভেবে লাভ নেই।
যদি প্রতিপক্ষ আমাকে প্রথাগত সামরিক শক্তিতে ধরে ফেলে, তবে আমাকে পরবর্তী স্তর নিয়ে ভাবতে হবে। অথচ নয়াদিল্লির ভাবনাচিন্তা যেন এখানেই এসে আটকে যায়। যুদ্ধবিমান-সমর সরঞ্জাম কিনেই কি শুধু প্রতিরক্ষা মজবুত করা সম্ভব? ইসরায়েল-এর 'আয়রন ডোম' বা লৌহ গম্বুজ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা আমরা জানি। কিন্তু সেরকম কিছু নিজেদের ক্ষেত্রে বলবৎ করতে পারি না কেন? এ ট্র্যাডিশন তো সেই কারগিলের অনুপ্রবেশ থেকেই চলছে। উরিতেও তাই দেখা গেল। সবসময় পাকিস্তানকে দোষ দিয়ে কি হবে যদি না আমরা নিজেদের ঘর নিজেরাই রক্ষা না করতে পারি?
২০০২ সালে বাজপেয়ী ভারতীয় সেনার দাবি মেনে সীমান্তে পাঁচ লক্ষ সেনা মোতায়েনের অনুমতি দিয়েছিলেন (অপারেশন পরাক্রম)। ১৯৭১ সালের পর সেটাই ছিল সবচেয়ে বড় সামরিক পদক্ষেপ। ভারতের পক্ষে ঝুঁকি নেওয়া হয়েছিল এই ভেবে যে পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার সাহস দেখাবে না কারণ ভারত তাতে যে পাল্টা আঘাত হানবে, তাতে পাকিস্তানের অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়ে যাবে।
আসরে নামতে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে
এই পরিস্থিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসরে নামে কারণ ভারত-পাক অশান্তির ফলে ওয়াশিংটনের আফগানিস্তান যুদ্ধ প্রবলভাবে প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। ৯/১১-র কয়েক মাস পরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে ওসামা বিন লাদেন-এর খোঁজে এবং সে লড়াইতে তার পাকিস্তানের সাহায্য প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তে যদি উপমহাদেশে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বড় ধরণের যুদ্ধ লেগে যেত, তাহলে সবকিছুই ভেস্তে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ওয়াশিংটন পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক পারভেজ মুশারফের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে এবং অবশেষে ২০০২ সালের অক্টবর মাসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
অতএব, মিয়াঁদাদ সাহেব, মোদীর ব্যক্তিগত নেতৃত্ব কিরকম, তার উপর এই সমস্যা নির্ভর করে না। নির্ভর করে দুই দেশের কূটনৈতিক সমীকরণ এবং সামরিক শক্তি কোন পর্যায়ে রয়েছে, তার উপর।