দীপাবলীতে কালীঘাটে মা দক্ষিণেশ্বরী পূজিতা হন লক্ষ্মীরূপে
দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে কালীঘাটে কালীপুজো হয় না, হয় ধনলক্ষ্মীর আরাধনা। মা দক্ষিণেশ্বরী এই বিশেষ দিনে পূজিতা হন লক্ষ্মীরূপে। প্রাচীন কাল থেকেই তা হয়ে আসছে। আজও তা বিদ্যমান।
দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার রাতে কালীঘাটে কালীপুজো হয় না, হয় ধনলক্ষ্মীর আরাধনা। মা দক্ষিণেশ্বরী এই বিশেষ দিনে পূজিতা হন লক্ষ্মীরূপে। প্রাচীন শাস্ত্রীয় রীতি মেনেই কালীঘাটের মন্দিরে মাকে 'কালীরূপে' পুজো না করে 'ধনলক্ষ্মী' রূপে পুজো করাই রীতি। প্রাচীন কাল থেকেই তা হয়ে আসছে। আজও তা বিদ্যমান।
শুধু লক্ষ্মীরূপে পুজোই নয়, ভোগের আয়োজনও হয় লক্ষ্মীপুজোর মতোই। লক্ষ্মীপুজোতে যা যা নিবেদন করা হয়, সেসবই এদিন কালীঘাটের দক্ষিণেশ্বরী মাকে নিবেদন করা হয়। দ্বীপান্বিতা অমাবস্যা তিথিতে মাকে দুপুরে ভোগ হিসাবে নিবেদন করা হয় সাদা ভাত, পোলাও, পাঁচরকম ভাজা, শুক্তো, পাঁচরকম মাছ, পাঠার মাংস, চাটনি, পায়েস এবং মিষ্টি। কিন্তু সন্ধ্যা থেকেই ভোগের উপাচারে ঘটে পরিবর্তন। সন্ধ্যায় মাকে গাওয়া ঘিয়ের ফুলকো লুচি, পাঁচরকম ভাজা এবং মিষ্টি সহযোগে ভোগ দেওয়া হয়। এই শীতলভোগের সঙ্গে সংযোজন করা হয় নারকেল নাড়ু, গুড়মাখানো খই, কদমা, বাতাসা, তিলের নাড়ু।
রাতে পুজো শেষে বিশেষ ভোগ হিসাবে দেওয়া হয় পোলাও, ঘি ভাত, পাঁচরকম ভাজা, চচ্চরি, মাছ, পাঠার মাংস, মিষ্টি প্রভৃতি। কালীঘাট মন্দিরের সেবায়েতরা জানান, এখানে দুর্গাপুজোর সময়ও মাকে ন'দিন ধরে দুর্গারূপে পুজো করা হয়। মহালয়া থেকেই শুরু হয় সেই পুজো। ন'দিন ধরে চলা এই পুজোয় ফুল, আলতা, সিঁদুর, লালপলা প্রভৃতি যা যা নিবেদন করা হয় মাকে, তা মন্দির থেকে বাইরে বের করা হয় না। দশমীর দিন কলাবউয়ের সঙ্গে ওই সকল ফুল-বেলপাতা এবং অন্যান্য সামগ্রী আদিগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়াই রীতি। আর কালীপুজোর রাতে লক্ষ্মীরূপে পুজো করাও শাস্ত্রীয় বিধি।
সত্যযুগে দক্ষ প্রজাপতি নিজের গৃহে আয়োজন করেছিলেন এক মহাযজ্ঞের, যা দক্ষযজ্ঞ বলেই পরিচিত। সেই যজ্ঞে দেবতা, মুনি-ঋষি, যক্ষ, কিন্নর সকলকে নিমন্ত্রণ করলেও, দক্ষ নিজের কন্যা সতী ও জামাতা শিবকে আমন্ত্রণ জানাননি। সতী বিনা আমন্ত্রণে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলে, তাঁর সম্মুখেই যক্ষ শিবের নিন্দা করেন। পতিনিন্দা সহ্য করতে না পেরে তৎক্ষণাৎ যজ্ঞকুণ্ডে আত্মবিসর্জন দেন সতী। তখন শিব ক্রুদ্ধ হয়ে সতীর শবদেহ কাঁধে নিয়ে বিশ্বধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। তাঁকে শান্ত করতে বিশ্বপালক বিষ্ণুসুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করে দেন। সতীর খণ্ডবিখণ্ড দেহের টুকরোগুলি পৃথিবীর নানা স্থানে পড়ে প্রস্তরখণ্ডে পরিণত হয় বলেই কথিত। সতীর ডান পায়ের চারটি আঙুল পড়েছিল কালীঘাটে। সেই থেকে সতীপাঠ হিসেবেই আখ্যায়িত কালীঘাট।
কলকাতার এই সুবিখ্যাত কালীমন্দিরটি একান্ন পীঠের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্রে পীঠদেবী দক্ষিণাকালী ও ভৈরব বা পীঠরক্ষক দেবতা হলেন নকুলেশ্বর। ১৮০৯ সালে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের জমিদার শিবদাস চৌধুরী, তাঁর পুত্র রামলাল ও ভ্রাতুষ্পুত্র লক্ষ্মীকান্তের উদ্যোগে বর্তমান মন্দিরটি নির্মিত হয়। পরবর্তীকালে মন্দিরের কিছু পোড়ামাটির কাজ নষ্ট হয়ে গেলে সন্তোষ রায়চৌধুরী সেগুলি সংস্কার করেন।
নব্বই ফুট উঁচু মন্দিরটি নির্মাণ করতে আট বছর সময় লেগেছিল এবং তৎকালীন সময়ে খরচ হয়েছিল ৩০,০০০ টাকা। বঙ্গীয় আটচালার আদলে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে নির্মিত মূল মন্দিরটির রয়েছে ৮ কাঠা জায়গার উপর। মূল মন্দির সংলগ্ন অনেকগুলি ছোটো ছোটো মন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরে পূজিত হন রাধাকৃষ্ণ, শিব ইত্যাদি। কালীঘাট কালীমন্দিরের কষ্টিপাথরের কালীমূর্তিটি অভিনব রীতিতে নির্মিত। মূর্তিটির জিভ, দাঁত, মুকুট, হাত ও মুণ্ডমালাটিও সোনার। মন্দিরে মধ্যে একটি সিন্দুকে সতীর প্রস্তরীভূত অঙ্গটি রক্ষিত আছে। এটি কারও সম্মুখে বের করা হয় না। কালীঘাট মন্দিরের পীঠরক্ষক দেবতা নকুলেশ্বর শিব মন্দিরটি ১৮৫৪ সালে তারা সিং নামে জনৈক ব্যবসায়ী নির্মাণ করিয়েছিলেন বলেই জানতে পারা যায়। ঐতিহ্যের এই মন্দির দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার বিশেষ দিনে ভক্তসমাগমে জমজমাট হয়ে ওঠে।