যুদ্ধের পর কতটা বদলেছে শ্রীলঙ্কার তামিলদের জীবন?
শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধ চলার সময় তামিল বাহিনীর মূল ঘাটি ছিল উত্তরাঞ্চলের কিলিনচ্চিতে, যা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রায় ১০ বছর পর সেই এলাকার কি পরিবর্তন হয়েছে? সেই যুদ্ধের ক্ষত কতটা
শ্রীলঙ্কার উত্তরাঞ্চলের একটি শহর কিলিনচ্চি, যা একসময় তামিল টাইটার বিদ্রোহীদের সদর দপ্তর ছিল।
দশ বছর আগে যুদ্ধের সময় এই শহরটি ছিল বিধ্বস্ত, ধংসস্তুপে ভরা একটি নগরী। কিন্তু আজ এখন সেটি ব্যস্ত একটি শহর, প্রধান সড়ক জুড়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম মেশিন, নানা ধরণের দোকানে ভরপুর।
বাহ্যিক ভাবে তামিল বিদ্রোহীদের সাবেক এই ঘাটির অনেক পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু সেই যুদ্ধের ক্ষত এখনো রয়ে গেছে তামিল সংখ্যালঘুদের ভেতর।
শহরের এক প্রান্তে আরো কয়েকজন নারীর সঙ্গে বিক্ষোভ করছে কান্দাস্বামী পুন্নমা। তারা সরকারের কাছে তাদের ছেলেমেয়ের সন্ধান চাইছেন, যারা সেই যুদ্ধে পরাজয়ের পর সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার পর থেকে নিখোঁজ রয়েছে।
বিবিসি বাংলার অন্যান্য খবর:
ভূমিকম্প সম্পর্কে ১২টি বিস্ময়কর তথ্য
নতুন মাদক 'খাট': মানবদেহের জন্য কতোটা ভয়াবহ
যৌনতার বিনিময়ে বাড়ি ভাড়া দিতে চান বাড়ি মালিক
সেদিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলছেন, ''যুদ্ধের শেষ মুহূর্তগুলোর পর যখন আমরা বিদ্রোহী এলাকা থেকে বেরিয়ে এলাম, আমরা কাঁটাতারের একটি বেড়ার মুখে পড়লাম। তামিল বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংযোগ আছে, এমন সবাইকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিলো সেনাবাহিনী এবং সবাইকে সাধারণ ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিলো।''
''তখন আমার ছেলে, পুত্রবধূ এবং তাদের দুই সন্তান নিজেদের সমর্পণ করলো। সেনা সদস্যরা তাদের একটি বাসে করে নিয়ে গেল। আমরা সবাই কাঁদতে কাঁদতে তাদের চলে যাওয়া দেখলাম। সেই শেষবার তাদের আমরা দেখলাম।''
তিন দশকের সেই লড়াইয়ে প্রায় বিশ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়ে গেছে, যাদের বেশিরভাগই তামিল। যুদ্ধ হয়তো শেষ হয়েছে, তবে তার মানবিক বিপর্যয়ের ছাপ এখনো রয়ে গেছে। যুদ্ধের পর পুনর্গঠনে অনেক কিছুই করা হয়েছে এসব এলাকায়। কিন্তু সত্যিই কি তামিল এলাকায় শান্তি এসেছে?
সেন্টার ফর পলিসি অল্টারনেটিভের বিশ্লেষক পাকিসতি সারাভানামুত্তু তা মনে করেন না।
তিনি বলছেন, ''আমি মনে করি না শান্তি এখনো এসেছে। আসলে এখন যুদ্ধ পরবর্তী একটি পরিস্থিতিতে আছি। আমাদের এখন সংঘাত পরবর্তী ব্যবস্থাগুলোয় যাওয়া দরকার, যার মাধ্যমে সংঘাতের মূল কারণগুলো আর না থাকে বা তৈরি না হয়।''
''সাবেক সরকার হয়তো মনে করেছিল, সামরিক বিজয়ই এই সংঘর্ষের সমাধান। কিন্তু সহিংসতার মূল কারণগুলো সমাধানে অনেক প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছিল, তার কিছু হয়েছে হয়তো বাস্তবায়ন হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগই প্রত্যাশা অনুযায়ী বাস্তবায়ন হয়নি।''
পরাজিত, অপমানিত এবং ভীত তামিলরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তাদের স্বায়ত্তশাসন অর্জন হয়তো খুব তাড়াতাড়ির সম্ভব হবে না।
তাদের কাছে এখন মূল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তাদের প্রিয়জনদের খোজ বের করা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অপহরণের ঘটনাগুলো তদন্তে এ বছরের শুরুতে একটি দপ্তর খোলা হয়েছে, যার চেয়ারম্যান সালিয়্যাপিরিজ।
তিনি বলছেন, ''আমি মনে করি, একটি দেশ হিসাবে তখনি আমরা এগোতে পারবো এবং পুনর্মিলন ঘটাতে পারবো যখন মানুষ মেনে নেবে, সেখানে কিছু অনিয়ম হয়েছে। সিংহলিদের এটা মেনে নিতে হবে যে সেখানে অনিয়ম হয়েছে, হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ নয়, বরং গুমের শিকার হয়েছে এবং বলতে হবে যে এরকম ঘটনা আর ঘটবে না।''
শ্রীলঙ্কান সরকারের মুখপাত্র শিরাল লাক্তেলাগা জোর দিয়ে বলছেন, সব নিখোঁজের ঘটনা তদন্ত করতে করে দেখতে চায় সরকার। তামিল তরুণদের এখনো আটকে রাখা হয়েছে, এরকম সব অভিযোগ তিনি নাকচ করে দিলেন।
মি. লাক্তেলাগা বলছেন, ''সরকারি দপ্তরের মাধ্যমে মানুষদের কাছ থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এটা এখনো চলছে। নিখোঁজদের বিষয়ে যে কেউ বলতে পারে সেটা চল্লিশ হাজার, দশ হাজার, ত্রিশ হাজার, একলক্ষ, কিন্তু এখন সরকারি কার্যক্রমের বিষয়ে এসব তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কেন শ্রীলঙ্কান সরকার এসব লুকিয়ে রাখবে?''
তবে এসব আশ্বাস শান্ত করতে পারছে না কিলিনচ্চিতে স্বজন হারানো মানুষদের।
নিখোঁজদের স্বজনরা বলছেন, শুধুমাত্র তাদের প্রিয়জন যখন ঘরে ফিরে আসবে, তখনি এই যুদ্ধ শেষ হবে আর সত্যিকারের শান্তি ফিরে আসবে।
(বিবিসির ইথিরাজন আনবারাসনের প্রতিবেদন)