পদ্মা সেতু: থামতে দেয়া হচ্ছে না কাউকে, চলছে সেনাবাহিনীর টহল
সাধারণ মানুষ যেন পদ্মা সেতুতে চলাচলের সময় নির্ধারিত আইন মেনে চলে, তা নিশ্চিত করতে সোমবার থেকে অতিরিক্ত কড়াকড়ি আরোপ করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
সোমবার সকাল থেকে সেতুতে মোটরসাইকেল প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। হেঁটেও উঠতে দেয়া হচ্ছে না মানুষকে।
বিবিসি সংবাদদাতা আবুল কালাম আজাদ সোমবার সকালে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে সেতুতে ওঠেন।
তিনি জানান, রবিবার সেতুর ওপর যেমন চিত্র দেখা গেছে, সোমবার পরিস্থিতি তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তিনি বলছেন, রবিবার বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়া ভিডিওতে সেতুর ওপর রাস্তার পাশে মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলেও সোমবার বলতে গেলে খালি ছিল রাস্তা।
সেতুর ওপর কোথাও কোথাও গাড়ি থামিয়ে মানুষজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনাবাহিনীর টহল গাড়ি তাদের সরিয়ে দিচ্ছিল।
পুরো সেতু এলাকাতেই সোমবারের চেয়ে বেশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে।
আরো পড়তে পারেন:
পদ্মা সেতু তৈরির নেপথ্যে কাজ করেছেন যারা
পদ্মা সেতুতে নাট-বল্টু খুলে ভাইরাল ব্যক্তিকে আটক করেছে পুলিশ
যানবাহনের জন্য খুলে দেয়ার পর পদ্মা সেতুতে গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলার হিড়িক
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, চলাচলে নিষেধাজ্ঞা
রবিবার সন্ধ্যায় পদ্মা সেতুর ওপর দুর্ঘটনার শিকার হয় একটি মোটরসাইকেল।
মোটরসাইকেলে থাকা দু'জন আরোহী গুরুতর ভাবে আহত হন।
পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে তাদের মৃত ঘোষণা করা হয়।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কয়েকটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে - যেগুলোর মধ্যে একটি বাইক চালকের হেলমেটের সাথে লাগানো ক্যামেরা দিয়ে ধারণ করা বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঐ ভিডিওতে দেখা যায় যে দুর্ঘটনার আগে থেকেই বাইক চালক নির্ধারিত গতির চেয়ে অনেক বেশি গতিতে বাইক চালাচ্ছিলেন।
এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরই সেতু বিভাগ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে, যেখানে পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত সোমবার ভোর ছয়টা থেকে সেতুতে মোটরসাইকেল প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
সোমবার সকাল থেকেই কার্যকর হয় এই নিষেধাজ্ঞা।
নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও অনেকে মোটরসাইকেল নিয়ে সেতু পারাপারের জন্য আসেন, কিন্তু তাদের সবাইকেই ফিরিয়ে দেয়া হয়।
- পদ্মা সেতুকে রাজনৈতিক অর্জন হিসাবে দেখাতে চাইছে আওয়ামী লীগ
- পদ্মা সেতুকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি আর পরিবহনে ব্যাপক চাঞ্চল্য
মোটর সাইকেল পার হচ্ছে ফেরিতে
শনিবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কারণে নিরাপত্তা ইস্যুতে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হলেও রবিবার সেতুর পাশাপাশি ফেরিও চালু রাখা হয় কয়েকটি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন আগেই জানিয়েছিল, পদ্মা সেতু চালু হলেও শিমুলিয়া ঘাট থেকে সীমিত আকারে ফেরি চলাচল অব্যাহত থাকবে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর রবিবার মাওয়া, শিমুলিয়া ফেরিঘাটগুলোতে যানবাহনের চাপ প্রত্যাশিতভাবেই কমে যায়।
তবে সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেলে পারাপার নিষিদ্ধ করার পর আজ ফেরির মাধ্যমেই নদী পার করে মোটরসাইকেল।
সোমবার সকালে শিমুলিয়া ঘাট থেকে একশোরও বেশি মোটরসাইকেল নিয়ে একটি ফেরি ছেড়ে যায়।
টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, অনেকে পিকআপে চড়িয়ে মোটরসাইকেল পার করছেন সেতু।
নাট-বল্টু খোলার অভিযোগে একজন আটক
ওদিকে টিকটকে প্রকাশিত হওয়া একটি ভিডিওর সূত্র ধরে পদ্মা সেতুর নাট-বল্টু খোলার অভিযোগে এক ব্যক্তিকে রবিবার আটক করে পুলিশ।
রবিবার সকালে প্রকাশিত হওয়া ঐ টিকটক ভিডিওতে দেখা যায় এক ব্যক্তি পদ্মা সেতুর রেলিং থেকে নাট বল্টু খুলে ফেলছেন।
সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, "এই হল আমাদের পদ্মা সেতু, আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু, এই নাট খুইলা আবার আটকায়া রাখছি।"
সামাজিক মাধ্যমে ঐ ভিডিওটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা নিয়ে তৈরি হয় আলোচনা-সমালোচনা।
এরপর রবিবার রাতে ঢাকার শান্তিনগর এলাকা থেকে ঐ ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
সোমবার সকালে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ এক সংবাদ সম্মেলনে জানান যে আটক হওয়া ঐ ব্যক্তির সাথে আরো কয়েকজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামী করে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ।
তিনি বলেন, "এরকম আরো কিছু ভিডিও পোস্ট হয়েছে, যা আমাদের নজরে এসেছে। অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামী করা হয়েছে। আমরা এই মামলাটি তদন্ত করবো।"
ছবি তোলা ও আইন ভাঙার হিড়িক
রবিবার জনসাধারণের জন্য পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর প্রথমদিনই ঘটে নানা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
রবিবার যান চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেয়ার আগে থেকেই সেতুর দুই প্রান্তে যানবাহনের দীর্ঘ সারি ছিল।
অনেকেই শনিবার ভোররাত থেকে সেতুর দুই প্রান্তে অপেক্ষা করছিলেন।
ভোর ছয়টার দিকে সেতু খুলে দেয়ার পর শুরুতে কয়েক ঘণ্টার জন্য যানজট তৈরি হয়।
প্রথমদিন সেতু পার হতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কারণে তৈরি হয়েছিল এই যানজট।
সেতুতে ওঠার পর রাস্তার পাশে গাড়ি ও মোটর সাইকেল দাঁড় করিয়ে ছবি তুলতে দেখা যায় বহু মানুষকে।
পুলিশের টহল ভ্যান কিছুক্ষণ পরপর তাদের সরিয়ে দিচ্ছিল।
কিন্তু টহল ভ্যান চলে গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল।
- সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে খরস্রোতা পদ্মা নদীকে যেভাবে বাগে আনা হয়েছে
- পদ্মা সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগার গুজব কেন?
এমনকি পুলিশি বাধা অমান্য করে বহু মানুষকে পায়ে হেঁটে সেতুতে উঠে পড়তে দেখা যায়।
এরকম একজনের সাথে বিবিসি সংবাদদাতার কথা হয়, যিনি বলছিলেন যে তাকে এক দফা সেনাবাহিনীর সদস্যরা আটকালেও তিনি তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেতুর ওপর উঠে পড়েন।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলেন যে তারা মানুষকে পায়ে হেঁটে উঠতে এবং সেতুতে যানবাহন থামাতে বাধা দেয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু এত মানুষ একসাথে উঠে পড়ছে যে তাদের সবাইকে আটকানো সম্ভব হচ্ছে না।
রবিবার বিকালে একটি চিঠিতে সেতুর ওপরে মানুষের হাঁটাচলা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনা কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি পাঠিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
সেইসঙ্গে একটি গণ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সেতুতে হাঁটাচলা বা ছবি না তোলার জন্য বিধিনিষেধ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সেখানে বলা হয়, পদ্মা সেতুতে গতিসীমা হবে ৬০ কিলোমিটার। সেতুর ওপর যানবাহন দাঁড়ানো যাবে না, যানবাহন থেকে নেমে হাঁটা বা ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ। পায়ে হেঁটে বা সাইকেল, রিক্সায় সেতুতে ওঠা যাবে না। সেতুর ওপর কোন ধরনের ময়লা ফেলা যাবে না।
আরো পড়তে পারেন:
পদ্মা সেতুতে ফেরির ধাক্কা কি নাশকতা না দুর্ঘটনা?
পদ্মা সেতুর ছবি সামাজিক মাধ্যমে দিতে মানা কেন
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে যেভাবে ব্যবহার করা যাবে
কোন গাড়িতে কতো টোল দিতে হবে?
পদ্মা সেতুর উপর যাতায়াতকারী যানবাহনের টোলের হার আগেই নির্ধারণ করে দিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সেই তালিকা অনুযায়ী টোলের হার:
- মোটরসাইকেল - ১০০ টাকা
- কার ও জিপ - ৭৫০ টাকা
- মাঝারি বাস - ২০০০ টাকা
- বড় বাস - ২,৪০০ টাকা
- মাইক্রোবাস - ১,৩০০ টাকা
- মিনিবাস - ১,৪০০ টাকা
- ছোট ট্রাক (৫ টন পর্যন্ত) - ১,৬০০ টাকা
- মাঝারি ট্রাক (৫ থেকে ৮ টন) - ২,১০০ টাকা
- মাঝারি ট্রাক (৮ থেকে ১১ টন) - ২,৮০০ টাকা
- বড় ট্রাক (তিন এক্সেল পর্যন্ত) - ৫,৫০০ টাকা
- ট্রেইলার - ৬,০০০ টাকা
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে তৈরি ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুটির মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলার সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সংযোগ তৈরি করেছে।
এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সেতু।
ত্রিশ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
শনিবার এই সেতু উদ্বোধনের পর প্রথম টোল দিয়ে সেতু পার হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে এদিন সারাদিনই সেতু যান চলাচলের জন্য বন্ধ রাখা হয় নিরাপত্তাজনিত কারণে।
এদিন ফেরিও বন্ধ রাখা হয়।
ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাথে এই রুট দিয়ে সড়কপথে যোগাযোগ কার্যত অচল ছিল এই রুট দিয়ে।