গুলশান হামলার এক বছর: জঙ্গি দমনে সাফল্য কতটা?
২০১৬ সালের ১লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ খুলে দিয়েছে। জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানের নকশা নতুন করে সাজিয়েছে বাংলাদেশের পুলিশ। কিন্তু সাফল্য কতটা?
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ইতিহাসে হলি আর্টিজানে হামলা একটি মোড় ঘুরানো বিষয়। এতো বড় মাপের জঙ্গি হামলা এর আগে বাংলাদেশে কখনো হয়নি।
হলি আর্টিজানে হামলার আগে অর্থাৎ পুরো ২০১৫ সাল এবং ২০১৬ সালের প্রথম কয়েক মাসে বিভিন্ন ঘটনা ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে বাংলাদেশে যে কোন সময় বড় মাপের একটি জঙ্গি হামলা হতে পারে।
২০১৫ সালে একের পর এক লেখক, ব্লগার ও প্রকাশক হত্যার সময় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
কিন্তু সে বিষয়গুলো বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকার গুলশানে ইতালির নাগরিক চেজারে তাবেলাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্য-ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট গ্রুপ সে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে।
তখন থেকে অনেকেই আঁচ করছিলেন যে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী নাগরিকরা হুমকির মুখে রয়েছেন।
কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে সে বিষয় তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ২০১৬ সালের ১লা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনা বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ খুলে দিয়েছে।
জঙ্গিবাদ বিরোধী অভিযানের নকশা নতুন করে সাজিয়েছে বাংলাদেশের পুলিশ।
জঙ্গিবাদ বিরোধী গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং অভিযান পরিচালনার জন্য কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গঠন করা হয়েছে।
কাউন্টার টেররিজম ইউনিট গঠনের পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তরে একটি আলাদা গোয়েন্দা শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যাদের কাজ জঙ্গি তৎপরতা সম্পর্কে নজরদারী করা।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হলি আর্টিজানের পরে বাংলাদেশে যতগুলো জঙ্গি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে সেগুলো সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে।
গত এক বছরে বিভিন্ন জঙ্গি-বিরোধী অভিযানে অন্তত ৫০ সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত এবং ১০০'র বেশি আটক করা হয়েছে। চলমান জঙ্গি বিরোধী অভিযানে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে চলতি বছরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লায় পুলিশের নিয়মিত তল্লাশির সময় যাত্রীবাহী একটি বাস থেকে দু'জন তরুণ পুলিশের উপর হামলা চালায়। বেশ কয়েক ঘন্টা চেষ্টার পর গ্রামবাসীর সহায়তায় তাদের আটক করে পুলিশ।
আটককৃত তরুণদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত। তখন পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের ডিআইজি ছিলেন মাহফুজুর রহমান, যিনি বর্তমানে ঢাকা রেঞ্জর ডিআইজি।
মি: রহমান বলেন, " তাদের সহযোগীদের দেয়া তথ্যমতে একের পর এক বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। সীতাকুণ্ড, কুমিল্লা, সিলেট ও ,মৌলভীবাজারে অভিযান চালানো হয়।"
বাংলাদেশের পুলিশ মনে করে গত এক বছরে তারা জঙ্গি-বিরোধী অভিযানে সফল হয়েছে। এছাড়া জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় নেতাদের অন্তর্ভুক্তি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচারণা এবং মসজিদে খুতবা দেয়াসহ বিভিন্ন রকমের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান মনে করেন গত এক বছরে নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে জঙ্গি বিরোধী তৎপরতা চালিয়েছে সেটিকে 'সাময়িক সফলতা' বলা যায়।
সমাধানের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কোন কৌশল চোখে পড়ছে না বলে মন্তব্য করেন এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, "রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটা কৌশল নীতি থাকতে হবে জঙ্গিবাদ সমস্যা মোকাবেলার জন্য।" সাময়িক সফলতা নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগা ঠিক হবে না বলে মি: মুনিরুজ্জামান মন্তব্য করেন।
গত এক বছরে বিভিন্ন অভিযানে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের অনেকেই নিহত এবং আটক হবার কারণে তাদের নেটওয়ার্ক ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে বলে নিরাপত্তা বাহিনী ধারণা করছে। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে তাদের আবারো সংগঠিত হবার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে।
পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মাহফুজুর রহমান বলেন, " বাকি যারা আছেন তাদের নেতৃত্ব পর্যায়ে একটা শুন্যতা তৈরি হয়েছে বলে আমরা জানতে পারছি। তবে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার মতো এখনো তাদের যথেষ্ট শক্তি আছে।"
তবে জঙ্গিরা যাতে সংগঠিত হতে না পারে সেজন্য পুলিশ সজাগ রয়েছে বলে জানান মি: রহমান।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, বিভিন্ন অভিযানে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের যাতে জীবিত আটক করা যায় সেদিকে নিরাপত্তাবাহিনীর বেশি মনোযোগী হওয়া দরকার। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, প্রতিটি অভিযানের সময় সন্দেহভাজনদের আত্নসমর্পনের আহবান জানানো হয় । কিন্তু আত্নসমর্পনের আহবান উপেক্ষা করে অনেক জঙ্গি নিরাপত্তাবাহিনীর উপর হামলা কিংবা আত্নঘাতি হবার পথ বেছে নিচ্ছে।