প্রকৃত গণতন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে এখন কি মোদী অ্যাপ গণতন্ত্রে ভরসা রাখছেন?
যেই নিদর্শন মোদী আজ রাখছেন, তা যদি আগামী দিনে অন্যান্য দলগুলিও অনুসরণ করতে শুরু করে, তবে ভারতীয় রাজনীতি-অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার
নোট বাতিলের বির্তক এখন ক্রমেই বড় রাজনৈতিক লড়াইয়ের দিকে এগোচ্ছে। আর সেটা হওয়ারই ছিল। গত ৮ নভেম্বর রাত্রে টিভিতে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আচমকা ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিলের ঘোষণা করার পর থেকেই বিরোধীরা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে যে মোদী নিজে কেন সংসদে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের যাবতীয় প্রশ্নের সওয়ালের জবাবদিহি করছেন না। সরকারের পক্ষ থেকে যেখানে বেশ বুক ফুলিয়েই বলা হচ্ছে যে এই বড় সিদ্ধান্ত বেশি লোক জানত না, সেখানে বিরোধীদের পাল্টা প্রশ্ন: গণতন্ত্রে এটা কী ধরণের রীতি?
টিভিতে সিদ্ধান্ত ঘোষণা কেন? এটা কি আমেরিকান রীতির গণতন্ত্র?
যুক্তিটি ফেলনা নয়। ভারতীয় গণতন্ত্র আমেরিকান ঘরানায় চলে না। এখানে সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে দলগতভাবে দায়িত্বপালন করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদী সেখানে বলতে গেলে মার্কিন রাষ্ট্রপতির মতো আচরণ করেছেন। টিভিতে কোনও সিদ্ধান্ত মার্কিন রাষ্ট্রপতি শোনান; ভারতীয় ব্যবস্থায় সেটা সাধারণত করা হয় না।
আর ৮ নভেম্বরের পরে এখন প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় রীতি মেনে কোনও বিতর্কতেও যাচ্ছেন না। আর এই সুযোগে নিজেদের গুরুত্ববৃদ্ধি করতে বিরোধীরাও আরও কড়া অবস্থান নিচ্ছে। সব মিলিয়ে, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত এখন অর্থনীতির চেয়েও বেশি রাজনৈতিক চালাচালির বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৮১ কোটির ভোটারের দেশে ৫ লক্ষ কী বলল না বলল তাতে কী এসে যায়?
আর বিরোধীদের এই আক্রমণ সামাল দিতে মোদী শিবির জানাচ্ছে যে নরেন্দ্র মোদী অ্যাপ-এর একটি জনসমীক্ষায় বলা হয়েছে যে পাঁচ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৯৩ শতাংশই ডেমোনটাইজেশন-এর পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে। মাত্র ২ শতাংশ মানুষ মনে করছে যে এটা ঠিক হয়নি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ভোট দিয়েছিলেন ৮১ কোটি মানুষ আর এখন মোদীর সমর্থকরা বলছেন পাঁচ লক্ষের তিরানব্বই শতাংশ মানুষ প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন, অর্থাৎ এটা ভালো?
সংসদকে এড়িয়ে মোদী এখন ভরসা করছেন পাবলিকের উপরে? বিপজ্জনক...
একদিকে প্রধানমন্ত্রীকে নিজের ক্যাবিনেট এবং সংসদকে এড়িয়ে ঘোষণা করতে দেখা যাচ্ছে, অন্যদিকে তাঁর এই সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল, তা যাচাই হচ্ছে তাঁরই নামে তৈরি অ্যাপের জনসমীক্ষায় দেখা ফল দিয়ে (অংশগ্রহণকারী 'ভোটার'এর সংখ্যা যেখানে ২০১৪-র তুলনায় নস্যি)। এই এক্সক্লুসিভ এবং প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের আশ্রয় নিয়ে শাসকদল যে বৈতরণী পার হতে চাইছে তা সবাই বুঝছেন, কিন্তু তাতে দেশের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির কতটা ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে কতজন ভাবছেন?
জনসাধারণ কতটা প্রাজ্ঞ, তা আমরা দেখেছি ব্রেক্সিট-এর ফলাফলে
আমরা দেখেছি ইদানিংকালে এই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র একটি দেশকে কতটা দিশেহারা অবস্থায় ফেলে দিতে পারে। ব্রেক্সিট-এর সময়ে দেখা গিয়েছে প্রকৃত গণতন্ত্রের নামে সাধারণ মানুষের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা ছেড়ে দিলে তা কীভাবে ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। গণতন্ত্রের কোনও লাভ তো হয়ই না, উল্টে শাসক গোষ্ঠীকেই নাজেহাল হতে হয়।
অর্থনীতির বদলে মোদী মাপছেন তাঁর নিজের জনপ্ৰিয়তা?
মোদী যে পথে এগোচ্ছেন তাতেও পরিণতি একই হওয়া অস্বাভাবিক নয়। মোদী এই মুহূর্তে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রভাব বুঝতে প্রকৃত অর্থনীতির বদলে তাঁর জনপ্রিয়তাকেই বেশি ভরসা করছেন। আর সেটা একটা বিপজ্জনক পন্থা। মধ্যবিত্ত এবং হিন্দিভাষী সমর্থকদের মধ্যে এই সমীক্ষার সিংহভাগ চালিয়ে ৯৩ শতাংশ মানুষের পিঠ চাপড়ানি পেয়ে মোদী যদি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে ভবিষ্যতেও এইভাবেই সরকারি কাজ চালাতে যান, তবে তাঁর সমর্থক গোষ্ঠীর বাইরে ছিটিয়ে থাকা মানুষজনের কপালে ঘোর দুর্ভোগ রয়েছে। তবে বিজেপির-র মতো একটি শহরকেন্দ্রিক দলের এইরূপ রাজনীতির বিপণন আশ্চর্যকর কিছু নয়। কিনতু, যাঁদের বিজেপি উপেক্ষা করছে, সেই সিংহভাগ মানুষ যদি কাল ব্যালট বাক্সে অন্যরকম কিছু চিন্তার প্রতিফলন ঘটায়?
ভারতের মতো অর্থ-সামাজিকভাবে বহুত্ববাদী একটি বিরাট দেশে কিছু শহুরে কার্ড ব্যবহারকারী মানুষকে খুশি রেখে আপ গণতন্ত্র চালানো যে যথেষ্ট ঝুঁকির কাজ, তা বোধহয় নেতিয়ে পড়া বিরোধকে চাঙ্গা হতে দেখেই মোদীর বিজেপি বুঝতে পারছে। আর এই সিস্টেমকে পাশ কাটিয়ে গোপনে সিদ্ধান্ত নিয়ে হাততালি কুড়োনোর রাজনীতির প্রবণতা যদি এক্ষুনি না থামে, তাহলে অন্যান্য নেতারাও এই পন্থা নেবেন আগামীদিনে আর তাতে ধসে পড়বে দেশের রাজনীতি-অর্থনীতিই।
যেই মোদী দু'বছর আগে নির্বাচনে জিতে সংসদের সিঁড়িতে মাথা ঠেকিয়ে ঢুকেছিলেন ভিতরে, আজ তাঁকেই প্রযুক্তি দিয়ে গণতন্ত্র চালাতে দেখে মনে ভয় আরও দানা বাঁধছে।