দোহাই, এই যুদ্ধের জিগির এবার বন্ধ করুন! পাকিস্তান ছাড়াও আমাদের অনেক কিছু ভাবার, করার আছে
উরির সেনা ছাউনিতে ১৮জন ভারতীয় জওয়ান জঙ্গিহানায় প্রাণ হারানোর পর সারা দেশ স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ এবং আবেগাপ্লুত। চারদিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। যেন, পাকিস্তানে ঢুকে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেই আমাদের সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু আদতে এটা দিশাহীনতারই নামান্তর।
আগেও বলেছি যে সাধারণ মানুষের আবেগে ভর করে বিদেশনীতি চলে না। বিদেশনীতি প্রণয়ন বিশেষজ্ঞদের কাজ। একটু বেহিসেবি পদক্ষেপ আরও বড় বিপর্যয় নিয়ে আসতে পারে। সেটা আশাকরি নরেন্দ্র মোদী সরকার ভালোমতোই জানেন। গত আড়াই বছরে যে ভারতের বিদেশনীতিতে অভিমুখে মোদী যে বড়সড় রদবদল এনেছেন, তা আবেগের তাড়নায় নয়, রিয়াল পলিটিক বা বাস্তববাদিতার নিরিখে। [প্রায় আড়াই বছর পরেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উড়ান অব্যাহত; তবে এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই]
এই হাল্লা রাজার মতো আচরণ এবার বন্ধ হোক
তবে কেন এখন মোদী সরকার পাকিস্তান-বিরোধী এই জিগির প্রশমনের রাস্তায় হাঁটছেন না? যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এমন সরাসরি হুমকি আসেনি, কিন্তু এমন প্রবণতা তো সরকারি দলের অন্দরমহলে দেখা যাচ্ছে। বুদ্ধি-যুক্তির কথা না বলে "পাকিস্তানকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হোক" ধরনের হুমকি দিয়ে কি লাভ হবে?আমরা সবাই জানি পরমাণু শক্তিধর পাকিস্তানকে কঠোর শাস্তি দেওয়া বলাটা যত সহজ, কাজটা করে দেখানো তার চেয়ে বহুগুন বেশি কঠিন, বা বলা চলে অসম্ভবই প্রায়।
কিন্তু আমরা এখন বাঘের পিঠে সওয়ার আর যুদ্ধবিরোধী কোনও যুক্তিপূর্ণ কথা আমাদের মনে ধরবে না। আর কেউ যদি বেশি যুদ্ধ-বিরোধী কথা বলতে যায়, তাকেই দেশবিরোধী আখ্যা দেওয়া হবে। [উরি: পাকিস্তান যতই জঙ্গি হামলা করুক, যুদ্ধ তার কোনও সমাধান হতে পারে না]
এই 'হাল্লা রাজার' মতো আচরণ ভারতের মতো দ্রুত উন্নতিশীল দেশের পক্ষে শুধু বেমানানই নয়, উদ্বেগজনকও বটে। পাকিস্তানের মতো একটি পিছিয়ে পড়া, ব্যর্থ দেশকে এতো গুরুত্ব দেওয়ার কোনও মানেই হয় না কারণ কোনওরকম সামরিক সংঘর্ষ হলে পাকিস্তান যত না ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার চেয়ে অনেক বেশি হবো আমরা কারণ যুদ্ধের ফলে আমাদের অর্থনীতি যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাতে আমরা পিছিয়ে যাব বহু দশক। সারা দুনিয়া আমাদের ঠিক যেই সময়ে সমীহের চোখে দেখতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে হিতে বিপরীত হবে নিঃসন্দেহে।
পাকিস্তানের জঙ্গিবাদকে মদত আসলে আমাদের মেরুকরণের রাজনীতিকেই রসদ জোগায়
কিন্তু এসব সুবুদ্ধিকে রাষ্ট্রযন্ত্র ইতিহাসে কতবার আমল দিয়েছে? আমল যদি সত্যি দেওয়া হতো, তাহলে দুনিয়ার ইতিহাস বারবার রক্তাক্ত হত না। ভারতে এখন যাঁরা ক্ষমতাসীন, তাঁদের সামাজিক-রাজনৈতিক দর্শন আসলে মেরুকরণের কথা বলে। আর এই মেরুকরণের ফসল ঘরে তুলতে তাঁদের প্রয়োজন পাকিস্তানকে।
কারণ যত পাকিস্তানের মাটি থেকে ভারত-বিরোধী কার্যকলাপ চলবে, ততই এই মেরুকরণের রাজনীতিতে বিশ্বাসী সৈনিকরা প্রয়োজনীয় রসদ পেতে থাকবে আর ততই তাঁদের পোয়াবারো। আবার যত এই মেরুকরণ হবে দেশের মাটিতে, তত ভারত-বিরোধী শক্তি আরও সক্রিয় হয়ে উঠবে সীমান্তে।
সুতরাং, এ চক্রাকারে চলতেই থাকবে অনন্তকাল আর দেশীয় জীবনের অন্যান্য গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়গুলি অবহেলিতই হতে থাকবে।
জাতীয়তাবাদী আবেগ রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যন্ত প্রিয় বিষয়
জাতীয়তাবাদী আবেগ যেকোনও ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর কাছেই প্রিয় কারণ এতে প্রায় নিঃখরচায় শাসনযন্ত্রকে চালানো যায়। খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, বেকারসংখ্যায় বৃদ্ধি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পানীয় জল-সড়ক এবং অন্যান্য পরিকাঠামোয় উন্নয়ন করতে গেলে যে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় এবং রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কাঠখড় পোড়াতে হয়, জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে তার সিকিভাগের একভাগ শ্রমও খরচ করতে হয় না আবার কোনও বিরোধিতারও সম্ভাবনা নেই (জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন বিরোধিতা করা মানেই তুমি দেশের শত্রু)।
কিন্তু ভারতের মতো সম্ভাবনাময় দেশকেও উগ্র জাতীয়তাবাদের উপর নির্বাহ করে থাকতে হবে?
কিন্তু ভারতের মতো সম্ভাবনাময় দেশকে কি সত্যি এই দেশপ্রেমের জিগিরের উপরে নির্ভরশীল থাকতে হবে? সেট বিংশ শতাব্দীর বা তারও আগের শাসনপন্থা। পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রের নেতৃত্বকে ওই কৌশল মানায়। আমরা কেন আজকে সামনে তাকাব না? কেন চীন বা আমেরিকার মতো অগ্রণী ভূমিকা নেব না আন্তর্জাতিক দুনিয়ায়? আঞ্চলিকতার ঊর্ধে যদি নাই উঠতে পারলাম, তবে আর আমরা কিসের দ্রুত উন্নতিশীল?
আসুন, আমরা এই অর্থহীন যুদ্ধের জিগির ত্যাগ করি আর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এমন এক পোক্ত নীতি এবং দেওয়াল বানাই যে সহজেই সেখানকার জঙ্গিরা টপকে এদিকে না চলে আসতে পারে। কিন্তু এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই থাকুক আমাদের দেশচালকদের কাজের একটি অংশমাত্র। বাকি সময়ে ভাবা হোক কিভাবে আমরা আরও এগোব, আমাদের অন্যান্য সমস্যাগুলিকে জয় করে। দয়া করে, ভারতকে আরেকটা পাকিস্তান বানিয়ে ফেলবেন না।তাতে আমাদের সবারই বিপুল ক্ষতি।