"কংগ্রেস-মুক্ত ভারত" বলে চেঁচাবেন না তো বিজেপির দাদারা, যদ্দিন কংগ্রেস আছে তদ্দিনই আপনাদের ভালো সময়
আজকাল বিজেপি নেতাদের এবং তাঁদের সমর্থকদের মুখে "কংগ্রেস-মুক্ত ভারত" কথাটা খুব শোনা যায়। গত লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদী যখন গান্ধীনগর থেকে 'গান্ধীবিনাশ'-এর লক্ষ্যে নামলেন, তখন থেকেই এর সূত্রপাত। নানা জনসভায় মোদী "মহাত্মা গান্ধী চেয়েছিলেন স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস দলটিকে তুলে দিতে। কংগ্রেস বাপুর কথা শোনেনি। কিনতু আমরা তাঁর স্বপ্ন সফল করবই।"
মোদীর সেই কথা টনিকের মতো কাজ করে। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকা কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার সেবারের নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়ে। তিন দশক পরে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে একটি দল। এমনকি লোকসভা নির্বাচনের পরেও মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, ঝাড়খন্ড এবং জম্মু ও কাশ্মীরে প্রথমবারের জন্য ক্ষমতায় আসে বিজেপি -- এককভাবে বা যৌথভাবে।
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের গলায় তখন প্রবল আত্মবিশ্বাসের সুর। বিজেপি আস্তে আস্তে এগোচ্ছে সম্পূর্ণ ভারত জয়ের দিকে, এমন ধারণা তখন গেরুয়া শিবিরে গভীর আকার নিচ্ছে। কিনতু ২০১৪ যতটা মসৃনভাবে বিজেপির পক্ষে গেল, ২০১৫ ঠিক ততটাই তার বিরুদ্ধাচরণ করল।
কংগ্রেসকে নাকানিচোবানি খাইয়ে বিজেপি আঞ্চলিক দলের কাছে ল্যাজেগোবরে হল
লোকসভা এবং তারপরে চার-চারটি রাজ্যে ক্ষমতায় এসে বিজেপি যখন ভাবতে শুরু করেছে যে "কংগ্রেস-মুক্ত ভারত" এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা, তখনই এল দিল্লি এবং বিহারের বজ্রাঘাত। ফেব্রুয়ারিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং অক্টবর-নভেম্বরে লালু প্রসাদ এবং নীতীশকুমারের কাছে ল্যাজেগোবরে হলেন মোদী-শাহরা। অথচ ঠিক এক বছর আগেকার লোকসভা ভোটে এই ঘোর মোদী -বিরোধী নেতাদের তাঁদের ঘরেই মাত করেছিল বিজেপি (লালুপ্রসাদ অবশ্য নির্বাচনের বাইরে)। তবে এবার কী হল?
বিজেপির সমস্ত জারিজুরি ওই কংগ্রেস-এর বিরুদ্ধেই
গল্পের সারবত্তা এখানেই। বিজেপি যতই "কংগ্রেস-মুক্ত ভারত" চাক না কেন, তাদের সমস্ত জারিজুরি কিনতু নুয়ে পড়া ওই দলটির বিরুদ্ধেই। যে-কোনও কর্তৃত্ববাদী শক্তিই চায় তার ক্ষয়িষ্ণু হলেও একটি প্রতিপক্ষ থাকুক যাতে সে বারংবার সেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে নিজের বুক বাজাতে পারে।
কিনতু সেই ক্ষয়িষ্ণু শক্তির সম্পূর্ণ পতনও আবার অভিপ্রেত নয় কারণ তাতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে, তাতে লোকসান আখেরে ওই কর্তৃত্ত্ববাদী শক্তিরই। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল-বাম কিংবা তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-এডিএমকের লড়াইও এই একই সূত্রে বাঁধা।
আন্তর্জাতিক স্তরেও ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে এই একই নিয়মে চলত দুনিয়ার রাজনীতি এবং উর্দ্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক জয় এলেও তার কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের সংখ্যাও বাড়ে। অতএব, যুদ্ধে ক্রমাগত জিততে হলে আমার প্রয়োজন হীনবল এক প্রতিপক্ষ।
বিজেপির ক্ষেত্রে সেই প্রতিপক্ষটি হল কংগ্রেস। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বিজেপি আজ কেন্দ্র ছাড়াও যে'কটি রাজ্যে ক্ষমতায়, তার প্রত্যেকটিতেই আগে কংগ্রেস রাজত্ব করেছে। ২০১৩ সালে দিল্লির সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনেও বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ছিল কারণ তার আগে একটানা ১৫ বছর সরকারে ছিল কংগ্রেস। কিনতু ২০১৫ সালে সেই একই দিল্লিতে মুখ থুবড়ে পড়ে বিজেপি -- ৬৭টি আসনের মধ্যে পায় মাত্র ৩টি। আর এবার ক্ষমতায় কিনতু আর কংগ্রেস ছিল না, ছিল কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির চ্যালেঞ্জ।
এরপর ২০১৬ সালের নির্বাচনগুলির দিকে তাকালেও সেই একই ছবি। অসমে কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের রাজত্ব হটিয়ে প্রথমবার ক্ষমতায় এল বিজেপি। কিনতু পশ্চিমবঙ্গ আর তামিলনাডু -- যেখানে আঞ্চলিক দলগুলির একচেটিয়া আধিপত্য, সেখানে কিছুই করতে পারে না। যেমনটি গতবছর পারেনি বিহারে।
আগামী বছর উত্তরপ্রদেশেও যে বিজেপি রাতারাতি ম্যাজিক ফলাতে পারবে, এমনটিও আশা করে না তার অতিবড় সমর্থকও।
কেরলে যদিও এতদিন কংগ্রেস-নেতৃত্ত্বাধীন ইউডিএফ-এর শাসন ছিল, কিনতু সে রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ গেরুয়া শিবিরের পক্ষে মানানসই হতে একটু সময় লাগবে। একটি আসন জিতে সে প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে নিঃসন্দেহে, কিনতু যেহেতু আদর্শের সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে থাকা বামেরা এখনও কেরলে একটি বড় শক্তি, তাই এই ডান-বাম লড়াইয়ের নিষ্পত্তি খুব শান্তিপূর্ণভাবে হবে না।
ভারতীয় রাজনীতি দীর্ঘদিন শাসন করতে বিজেপির দুর্বল কংগ্রেসকে প্রয়োজন
তবে এক কেরলকে বাদ রেখে বিজেপির নির্বাচন জেতার ধাঁচ লক্ষ্য করলে এটি পরিষ্কার যে দীর্ঘদিন ভারতীয় রাজনীতি শাসন করতে হলে তার কংগ্রেসকেই প্রয়োজন। অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তিগুলির সঙ্গে তার এঁটে ওঠা মুশকিল কারণ ইতিহাসগতভাবে এই দলগুলির রাজনীতির প্রতি-রাজনীতি বিজেপির জানা নেই।
কংগ্রেসের অবক্ষয়ের সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রের প্রসাদ পেতে একসময়ে এই দলগুলিই বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল (বাজপেয়ী জমানা মনে করুন) আর এখন তাদের নিজেদের নিজেদের জমিতে বিজেপিকে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়তেও রাজি নয়। সমীকরণের এমন আমূল পরিবর্তনের মোকাবিলা করার কৌশল বিজেপির অন্তত এই মুহূর্তে জানা নেই।
আঞ্চলিক দলগুলিকে হারানো বিজেপির পক্ষে কঠিন
বিশেষ করে, বিভিন্ন রাজ্যে যেখানে বিজেপিকে এখনও 'সাম্প্রদায়িক' দল হিসেবে ধরা হয় এবং আঞ্চলিক দলগুলি তাদের নিজস্ব জনপ্রিয়তাবাদের রাজনীতির মাধ্যমে নিজেদের ভোটব্যাঙ্ক সুগঠিত করেছে, সেখানে গেরুয়া শিবিরের পক্ষে তাদের একপেশে 'হিন্দু জাতীয়তাবাদী' কর্মসূচি দিয়ে বেশিদূর এগোনো সম্ভব নয়। এক মোদীর উন্নয়নের বুলি দিয়েই যদি বা কিছু হয় কিন্তু ইদানিংকালে গেরুয়া ভক্তরা যেভাবে দাদরি জাতীয় কান্ড ঘটাচ্ছেন এবং দলিতদের আক্রমণ করছেন, তাতে বিজেপির সম্ভাবনা গো-বলয়ের বাইরে আর কদ্দুর প্রসারিত হবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
বিজেপির ভরসা তাই ওই রাহুল গান্ধীর মতো শিক্ষানবিশ রাজনীতিবিদরাই। উনি যত লোক হাসবেন, কেন্দ্রীয় স্তরে মোদীর গ্রহণযোগ্যতা ততই বজায় থাকবে। আর ভৌগোলিকভাবে সীমিত ক্ষমতা নিয়ে আঞ্চলিক দলগুলির কেন্দ্র থেকে মোদীকে হটানো সম্ভব নয়। তাই বিজেপির পক্ষে ক্রমাগত "কংগ্রেস-মুক্ত ভারত" মুখে বলে চলাই ভালো। বাস্তবে তার প্রতিফলন না ঘটে শ্রেয়।