নোট বাতিলের এই সিদ্ধান্ত কি শুধু তালি কুড়োনোর জন্যই?
একটা জটিল সমস্যার সমাধান কি তুড়ি মেরে হয়? এই যে দেশের অর্থনীতি একটা ধাক্কা খেল, এত মানুষের ক্ষতি হল, এর দায় কে নেবে?
বিদেশনীতিতে তুড়ি মেরে, বুক বাজিয়ে কথা বলা অপেক্ষাকৃত সহজ ব্যাপার। কারণ, সেখানে দেশের স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। কিনতু অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সবকিছু তলিয়ে না দেখে ঝুঁকি নেওয়াটা যে ব্যুমেরাং হতে পারে, তা আমরা আগেও দেখেছি। সাধারণ মানুষকে অসুবিধায় ফেলে বা তাঁদের কথা উপেক্ষা করে নিজের কার্যসিদ্ধির উদ্যোগ নিলে কী হতে পারে তা আমরা ১৯৭৭ বা ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনে চাক্ষুষ করেছি।
আর এবার ২০১৬তে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও প্রায় একই ভুল করছেন। তাঁর নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত দীর্ঘমেয়াদে কী সুফল আনবে তা এই মুহূর্তে বিশেষজ্ঞদের বিষয় কিনতু দিন-আনি-দিন-খাই ছাপোষা মানুষের কাছে এই পদক্ষেপ যে আস্ত অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা নিয়ে দ্বিমত নেই।
মোদীর জাপানে "কীরকম দিলাম" হাবভাব দেখে তাঁর গোয়ায় আবেগাপ্লুত হয়ে পড়া দেখলে বেশ সন্দেহ জাগে মনে। উনি কি তাহলে দুই ক্ষেত্রে দুই ধরনের দর্শকের সামনে নিজেকে দু'ভাবে মেলে ধরছেন?
যদি তাই হয়ে থাকে, তবে তাকে দ্বিচারিতা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রবাসীদের সামনে নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত যে বাহবা আনবে তা বুদ্ধিমান রাজনীতিবিদ মোদী খুব ভালো করেই জানেন। আর দেশে ফিরে নিজের দীনবন্ধু ভাবমূর্তিকে চাঙ্গা করতে সজল চোখে আবেদন করবেন সেটাও আশ্চর্যের কিছু নয়।
কিনতু এত কান্ড না করে তো পরিকল্পনায় আরেকটু আঁটঘাঁট বেঁধে নামলেই তো হত। অনেকে বলছেন তাতে অপরাধীরা পার পেয়ে যেত। কিনতু, কুড়ি শতাংশ অপরাধীকে শিক্ষা দিতে গিয়ে আশি শতাংশ নির্দোষ খেটে-খাওয়া মানুষকে অসুবিধায় ফেলা কী ধরনের 'মাস্টারস্ট্রোক'?
যথেষ্ট নোট বাজারে না ছেড়ে, অসংখ্য এটিএম-এর প্রযুক্তিতে বদল না এনে, ব্যাঙ্ক ব্যবস্থায় কোনও উন্নতি না ঘটিয়ে এমন হঠকারিতা দেখিয়ে তারপর খুচরো সিদ্ধান্ত (আঙুলে কালি লাগানো, এটিএম-এ টাকা তোলার সীমা বাড়িয়ে, ব্যাঙ্কে সীমা কমিয়ে, ইত্যাদি) নিয়ে বেগতিক অবস্থা সামলানোর প্রচেষ্টা কি একজন প্রকৃত দক্ষ প্রশাসকের পরিচয় দেয়?
নাকি
বাস্তবে
ফল
ফোলানোর
চেয়ে
প্রশাসক
এবং
তাঁর
দলবলের
প্রধান
লক্ষ্য
হাততালি
কুড়োনো?
জাপানে
প্রধানমন্ত্রীর
কথাবার্তা
শুনে
কতকটা
সেরকমই
মনে
হচ্ছিল।
আর
তাছাড়া
এই
যে
"প্রধানমন্ত্রী
ছাড়া
আর
কেউ
জানত
না
এই
সিদ্ধান্তের
কথা"
বলে
এত
গর্ব
নিয়ে
দাবি
করা
হচ্ছে,
সেটাও
বা
কতটা
গণতান্ত্রিক?
হ্যাঁ, অনেকেই বলবেন যে এদেশে ফসল ফলাতে গেলে এমনটাই করা দরকার কারণ তর্কবিতর্ক করতে গেলে আসল কাজ আর হবে না। তাহলে তো বলতে হয় ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী গণতন্ত্রকে শিকেয় তুলে দিয়ে ঠিক কাজই করেছিলেন। আজ আর তাহলে মোদী এবং তাঁর দল সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন কেন? নির্বাচন করারই বা দরকার কি সেক্ষেত্রে?
আসলে "আমি সব জানি" মানসিকতা নেতাদের পেয়ে বসলে তার মূল্য চোকাতে হয় সাধারণ মানুষকেই। বর্তমান সরকার ব্যক্তিকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে পুরো গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, আমলাতন্ত্র সবই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে প্রায়। প্রধানমন্ত্রী যা ভালো বুঝবেন, তাই করবেন। বাকিরা দল ভারী করবেন শুধু।
আর এ যে শুধু মোদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা নয়। যেই নেতারা আজ মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের ঘোরতর বিরোধিতায় নেমেছেন, তাঁরাও বা কম যান কিসে? দু'জন মুখ্যমন্ত্রীকে দেখা যাচ্ছে অহোরাত্র নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের মুণ্ডুপাত করছেন। তাঁরা তো সংসদের সদস্যও নন। নিজেদের রাজ্যের প্রশাসনিক কাজকর্ম ফেলে তাঁরাই বা কী রাজধর্ম পালন করছেন?
কিন্তু তাঁরা না হয় বিরোধী। আগামী লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির খেলায় মেতেছেন। কিনতু যে প্রধানমন্ত্রীর কাঁধে এত মানুষ বিশ্বাস করে আড়াই বছর আগে দায়িত্ব দিয়েছিলেন দেশকে ঠিক দিশায় নিয়ে যেতে, তিনি আচমকা নিজের দেশের অর্থনীতির বিরুদ্ধেই এমন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করে বসলেন কেন?
ইতিহাসের মতো অর্থনীতিও কিনতু ক্ষমা করে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি তা জানেন না?