আমেরিকার এই অভূতপূর্ব নির্বাচন দেখে অবাক শত্রু, মিত্র সবাই
এবছরের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচার পর্বের নমুনা দেখে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশই বিস্ময়প্রকাশ করেছে; বিশ্বের সবচেয়ে সমাদৃত যে গণতন্ত্র, তার আজ এ কী হাল?
বিশ্বের একমাত্র মহাশক্তির এবছরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের অধ্যায়টি সমস্ত দুনিয়াতেই সারা ফেলেছে। সে শত্রু, মিত্র বা নিরপেক্ষপক্ষ যেই হোক না কেন, ২০১৬-র মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বহর দেখে সবাই অবাক। এ কী হচ্ছে গণতন্ত্রের পীঠস্থানে? স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় প্রতীক হিসেবে দেখা হয় যে রাষ্ট্রকে, দুনিয়ার সবচেয়ে সফল গণতন্ত্র হিসেবে নাম যার, সেই আমেরিকাতেও এরকম হয়? এমন নানা প্রশ্ন উঠছে বহু মহলে।
ইমেল বিতর্ক থেকে শুরু করে মহিলাদের সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য, মৃত সৈনিকের বাবা-মায়ের সঙ্গে তরজা, নিম্নরুচির ব্যক্তিগত আক্রমণ - এই মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দুই পদপ্রার্থী হিলারি ক্লিন্টন এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ঘিরে কী না হয়নি?
এমনকি নির্বাচনের ফল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতেও দেখা গিয়েছে এক পদপ্রার্থীকে যা দুনিয়ার সবচেয়ে আদৃত গণতন্ত্রে অভাবনীয়। আর যেখানে খোদ মার্কিন দেশের নাগরিকরাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই নাটক দেখে ক্লান্ত, সেখানে বহির্বিশ্বের প্রতিক্রিয়া যে আরও তীব্র হবে সে ব্যাপারে আর সন্দেহ কী?
আমেরিকা কি বদলে গেল? আশঙ্কায় মিত্র দেশগুলি
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর একটি প্রতিবেদনটির মতে, আমেরিকার পুরোনো মিত্র দেশ যারা, তাদের প্রশ্ন: তবে কি আমেরিকার চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন হল? ভবিষ্যতে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আগের মতোই প্রয়োজনে পাশে পাওয়া যাবে? রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেটো-বিরোধী কথাই যে তাদের আশঙ্কা বাড়িয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
শত্রুপক্ষ অবশ্য উল্লসিত আমেরিকার এই 'নৈতিক' পতন দেখে। অবশ্য তাদের এই উল্লাসে মেশানো রয়েছে বিস্ময়ও। যে দেশ নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে থাকে হরবখত, তার এত সহজেই পতন হতে পারে? ভাবছে তারা।
একথা অনস্বীকার্য যে এই বছরের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্বের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৈতিক ভাবমূর্তিকে অনেকটাই মলিন করে দিয়েছে, বলা হয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট-এর প্রতিবেদনটিতে।
বেইরুটের এক ব্যক্তির প্রশ্ন শুনে অবাক হতে হয়। আনাস আল-আবেদ নামক এক সাতাশ বছর বয়সী ক্যাফে কর্মী শুনেছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পের মহিলাদের সম্পর্কে কুমন্তব্য করার কথা।
"আমেরিকা তো আরব দুনিয়াকে নানা ব্যাপারে জ্ঞান দিয়ে থাকে। আর এখন আমরা দেখছি ওদেশের গণতন্ত্রে এমন দু'জন প্রার্থীকে নিয়ে কথা হচ্ছে যাঁদের মধ্যে একজন পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি করেন আর অন্যজন খোদ নিজেদের সিস্টেমের উপরে আস্থাশীল নন। এই যদি গণতন্ত্র হয় তবে আমাদের কাছে তার কোনও প্রয়োজন নেই," ওয়াশিংটন পোস্টকে সাফ বলেন আল-আবেদ।
প্রতিবেদনটিতে অবশ্য এও বলা হয়েছে যে এই প্রথম আমেরিকার ভাবমূর্তি বিশ্বের দরবারে ধাক্কা খেল তা নয়। ইরাক যুদ্ধের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট বদনাম কুড়িয়েছিল। পরে বারাক ওবামার রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন হলে সে ক্ষতে কিছুটা প্রলেপ পড়ে। কিনতু এবারের নির্বাচনী অধ্যায় ফের আহত করল আমেরিকাকে।
এমনকি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশসচিব জন কেরিও সম্প্রতি লন্ডনের একটি অনুষ্ঠানে স্বীকার করে নেন যে এবছরের নির্বাচনী প্রচার শুধুমাত্র আমেরিকাকে যে লজ্জিত করেছে তা নয়, তার বিশ্বজোড়া প্রভাবকেও খর্ব করেছে।
অবশ্য মার্কিন গণতন্ত্রে যা ঘটছে তা কিনতু ব্যতিক্রমী কিছু নয়, জানাচ্ছে ওয়াশিংটন পোস্ট। দুনিয়াজুড়েই বিভিন্ন গণতন্ত্রে দেখা যাচ্ছে পপুলিস্ট এবং জেনোফোবিক রাজনীতির উত্থান। আর অপরদিকে, গণতন্ত্রের এই পতন দেখে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছেন রাশিয়া বা পশ্চিম এশিয়ার নানা অগণতান্ত্রিক নেতৃত্ব।
আমেরিকার পতনের শুরু, বলছে শত্রু চিন
চিনের মতে, এ হচ্ছে মার্কিন গণতন্ত্রের পতনের শুরু। চিনে অবস্থিত মার্কিন রাজনীতির বিশেষজ্ঞদের অন্তত তাই ধারণা বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট। বার্তাটি এই: একদিকে আমেরিকা যেমন দুর্বল হচ্ছে, অন্যদিকে চিনের অবস্থান আরও শক্তিশালী হচ্ছে, জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।
চিরশত্রু রাশিয়াও উছ্বসিত আমেরিকার এই 'অবক্ষয়'-এ। এবারের নির্বাচনে যে রাশিয়ার নাকগলানোর দাবি করা হয়েছে, তাতে রাশিয়ানরা নিদারুন খুশি। "আমরা আমাদের দেশে বসে বসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারছি, এটা ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়," ক্রেমলিনের প্রাক্তন পলিটিক্যাল কনসালট্যান্ট গ্লেব পাভলোভস্কি বলেন ওয়াশিংটন পোস্টকে।
কী ভাবছে ভারত?
ভারতের সঙ্গে যদিও সাম্প্রতিককালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে এবং অনেক ভারতীয়ই আজও মার্কিন দেশের গণতন্ত্রকে আদর্শ মানেন, কিন্তু এবারের নির্বাচনী প্রচার কিছুটা হলেও সেই বিশ্বাসকে টলিয়ে দিয়েছে। "এই প্রচারের নমুনা দেখে মনে হচ্ছে আমরা ভারতীয়রা একটু হলেও যেন উন্নত বেশি," হরিয়ানার ওপি জিন্দাল গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিব বিশ্বনাথন জানিয়েছেন ওয়াশিংটন পোস্টকে।