উত্তরপ্রদেশ নির্বাচন, OROP: সেনাকে নিয়ে সরকার, বিরোধীপক্ষ নির্লজ্জ রাজনীতির খেলায় মাতোয়ারা
একদিকে যখন মোদী সরকার সীমান্তে সেনার বাহাদুরির কৃতিত্ব নিজে নিয়ে উত্তরপ্রদেশের ভোট বৈতরণী পার করতে মরিয়া, তখন বিরোধীপক্ষ OROP বিতর্ক ভাঙিয়ে পাল্টা আঘাতে উদ্যমী; সেনার এই রাজনীতিকরণ কোন পথে নিয়ে চলেছে?
প্রতিবেশী পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের একটি বড় পার্থক্য রয়েছে সেই স্বাধীনতার আমল থেকেই। পাকিস্তানে যেমন সামরিক শক্তি প্রথম থেকেই সক্রিয় কারণ সেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সেভাবে গড়ে ওঠেনি এবং অসামরিক নেতৃত্ব প্রথম থেকেই ঠুঁটো জগন্নাথ। ভারতে ঠিক ঘটেছে তার উল্টোটা।
এখানে রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সামরিক নেতৃত্বকে প্রথম থেকেই আলাদা করে দেওয়া হয়েছে যাতে প্রশাসনিক কাজকর্মে তাঁরা নাক না গলাতে পারেন। গণতন্ত্রকে শক্ত করার লক্ষ্যে সামরিক শক্তিকে লাগাম পড়ানো যে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তা জওহরলাল নেহরু সহ অনেক প্রাজ্ঞ নেতাই বুঝেছিলেন। তাই ভারতে সামরিক রাষ্ট্র বা সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ সেভাবে হয়নি, সেনা অভ্যুত্থান তো দূরের কথা।
সেনাকে নিয়ে রাজনীতিবিদদের আদিখ্যেতা চলছে তো চলছেই
কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ভারতের চিত্র অনেক বদলেছে। এখন সেনাবাহিনীকে নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের - বিশেষ করে সরকার পক্ষের - অতি গদগদ ভাব সাধারণ চোখে বেশ ভালো লাগলেও গভীরে কিন্তু এটা সেনাবাহিনী এবং দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ, দু'টিরই ক্ষতি করছে। দেখা যাক কেমন করে।
পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে ভারতের সমস্যা যত বাড়ছে এবং রাজনৈতিক স্তরে সমাধান পাওয়ার সম্ভাবনা যত স্তিমিত হচ্ছে, ততই সামরিক উপায়ে ঝামেলা চোকানোর কথা ভাবা হচ্ছে। আর এর ফলে দৈনন্দিন রাজনৈতিক জীবনে ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে সেনাবাহিনীর গুরুত্ব। সাধারণ মানুষের মনে বৈধতা পাচ্ছে এক ধরনের 'সামরিক রাষ্ট্রের' প্রতিচ্ছবি। আর শুধু তাই নয়।
মোদীর দল যখন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ভাঙিয়ে উত্তরপ্রদেশের চ্যালেঞ্জ টপকানোর লক্ষ্যে এগোচ্ছে
যতই শাসকদল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ইত্যাদির সাহায্যে পাকিস্তানের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ টপকানোর কথাও ভাবছে, ততই বিরোধীপক্ষও এই একই ইস্যু ভাঙিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। তাই মোদী এবং তাঁর দলবল সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে যখন ডগমগ হয়ে উঠছেন আর ভাবছেন জাতীয়তাবাদী ভাবধারাকে আরও সুড়সুড়ি দিয়ে তাঁরা উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের মতো কঠিন পরীক্ষা নিমেষে উতরে যাবেন, তখনই বিরোধীরাও 'এক পদ, এক পেনশন' বা সংক্ষেপে 'ওরওপ' নিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছেন।
তখন OROP নিয়ে প্রাক্তন জওয়ানের আত্মহত্যা সুযোগ করে দিল বিরোধীদের
গত মঙ্গলবার (নভেম্বর ১) ওরওপ-এর মাধ্যমে বর্ধিত অর্থ না পাওয়ার অভিযোগে দিল্লিতে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন এক প্রাক্তন জওয়ান আর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নেমে পড়েন কংগ্রেস এবং আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব, মোদী সরকারকে কোনঠাসা করার জন্য। রাহুল গান্ধী এবং খোদ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও আটক হন মৃত জওয়ানের পরিবারের সঙ্গে দেখা জোরটা গিয়ে। এমনকি আটক হন ওই জওয়ানের পুত্র এবং তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও।
অর্থাৎ, এটা পরিষ্কার যে সুযোগ পেলে সেনাবাহিনীর আবেগ নিয়ে খেলতে অরাজি নয় কোনও রাজনৈতিক পক্ষই। সীমান্তে জওয়ানদের বীরগাঁথা ভাঙিয়ে যেমন শাসকদল খাচ্ছে, তেমনি ঘরোয়া রাজনীতিতে সেই জওয়ানদের পূর্বসূরিদের প্রতি রাষ্ট্রের অনীহা নিয়ে বিরোধীরা সুযোগ নিচ্ছে।
আর এই নিম্নমানের রাজনীতির ফলে সেনা নামক প্রতিষ্ঠানটির হয়ে চলেছে ব্যাপক রাজনীতিকরণ। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জনকরা ঠিক এই অবস্থাটিকে এড়াতেই সেনাকে বিচ্ছিন্ন করেছিলেন রাজনীতি থেকে আর বর্তমান নেতৃত্ব নিজেদের লক্ষ্য চরিতার্থ করার জন্য মেতেছেন আগুন নিয়ে খেলায়।
OROP নিয়ে সরকারের ঢক্কানিনাদের আদৌ প্রয়োজন ছিল কি?
বিরোধীপক্ষকে রাজনীতি করার দায়ে অভিযুক্ত করার আগে সরকারের নিজের কাঁধে দায়িত্ব বর্তায় সঠিক পথ দেখানোর। ধরপাকড়ের রাজনীতি বা একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যিনি কিনা নিজেই এক সময়ে সেনাপ্রধান ছিলেন তাঁর মুখে "প্রয়াত জওয়ানের মানসিক অযথা স্থিতিশীল ছিল কিনা আগে দেখা দরকার" শুনলে মনে হয় না সরকারের বিন্দুমাত্র সদিচ্ছা রয়েছে এই সমস্যার সমাধান খোঁজার।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পার্রিকর-এর সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন এবং সরকারের তরফ থেকে নানা সাফাই দেওয়া হয় কিনতু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
আসলে অতিরিক্ত ঢক্কানিনাদের ফলেই এই সরকারকে অনেক ব্যাপারে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। 'এক পদ এক পেনশন' নিয়ে এই সরকার আগের সরকারকে দুষে এত বেশি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জনসমক্ষে যে তাতে মানুষ অধৈর্য হয়ে পড়েছে ফল দেখার জন্য। অথচ সরকারের তরফ থেকে নিঃশব্দে কাজটি করলে কিনতু বিরোধীরা 'এক পদ এক পেনশন'-কে সরকারের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাল্টা হাতিয়ার বানাতে পারত না খুব সহজে।
কিন্তু পাবলিক রিলেশন্স-সর্বস্ব এই সরকার সবেতেই আগে হট্টগোল করতে আগ্রহী। তাতে যে নিজেদের বা সেনার মতো একটি শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠানের কতটা ক্ষতি হচ্ছে তা নিয়ে তাঁদের চিন্তাভাবনার সময় নেই।
সেনাবাহিনীর এভাবে নির্লজ্জ রাজনীতিকরণ চলতে থাকলে তা ভবিষ্যতে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির সমূহ ক্ষতি, তা বোঝার দায় তাহলে কার?