প্রশাসনিক সুবিধার থেকেও রাজনৈতিক স্বার্থ মুখ্য, বাংলা এখন ১৪ থেকে ২১
এক কূল ভাঙে, এক কূল গড়ে। তৈরি হয় নতুন জনপদ। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজ্যও বারবার তাঁর মানচিত্রে বদল ঘটিয়েছে। এক জেলা থেকে তৈরি হয়েছে একাধিক জেলা।
এক কূল ভাঙে, এক কূল গড়ে। তৈরি হয় নতুন জনপদ। সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজ্যও বারবার তাঁর মানচিত্রে বদল ঘটিয়েছে। এক জেলা থেকে তৈরি হয়েছে একাধিক জেলা। অন্য রাজ্য ভেঙে বাংলায় অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে নতুন জেলার। কখনও এক জেলা ভেঙে তৈরি হয়েছে একাধিক জেলা। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থেই বারবার ভাঙাগড়ার এই খেলা চলেছে।
এই ভাঙা-গড়ার খেলায় বারবার বিতর্কও দানা বেঁধেছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দোষারোপ করেছে, রাজনৈতিক সুবিধার্থেই এই বিভাজন। রাজনীতির স্বার্থ দেখার সেই অভিযোগ যেমন উঠেছে, সদ্য ২১ নম্বর জেলা হিসেবে বাংলার মানচিত্রে স্থান করে নেওয়া কালিম্পংকে কেন্দ্র করে। কেন একটা মাত্র বিধানসভা কেন্দ্রকে নিয়ে আস্ত একটা জেলা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিরোধী দল সিপিএম।
স্বাধীনোত্তর পর্বে ১৪টি জেলা নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের। ১৯৪৭ সালে দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভেঙে দু'ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বাংলার পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে যে রাজ্য গঠন হয়েছিল, তার নাম পশ্চিমবঙ্গ। দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর।
১৫ তম জেলা কোচবিহার
স্বাধীনতার পর কোচবিহার ছিল রাজ্য। এক দেশীয় একটি রাজ্য। সেই রাজ্যই বাংলার সঙ্গে অন্তর্ভূক্ত হল স্বাধীনতার দু'বছর পর। অর্থাৎ ১৯৪৯ সালের ২০ আগস্ট বাংলা পেল তার ১৫ তম জেলাকে। বাংলার ভুখণ্ড বর্ধিত হল। কোচবিহার রাজ্যের বিলুপ্তি ঘটল। বাংলার অন্তর্গত নতুন জেলার স্বীকৃতি পেল কোচবিহার। ১৯৫০ সালের ১৯ জানুয়ারি কোচবিহারের প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষ হয়। ঘোষিত হল কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চদশ জেলা।
কোচবিহার অতীতে কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। কামরূপের রাজধানী দ্বিধাবিভক্ত হলে কোচবিহার 'কামতা'-র অন্তর্গত। ১৭৭২ সালে ভুটানের সঙ্গে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তির ফলে কোচবিহার ব্রিটিশদের একটি করদ রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯৪৯ সালের ২০ অগস্ট রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ কোচবিহার রাজ্যকে পশ্চিমবঙ্গের হাতে তুলে দেন।
ষোড়শ জেলা পুরুলিয়া
১৯৫৬ সালে রাজ্য পুনর্গঠন হয়। সেই রাজ্য পুনর্গঠন আইন অনুযায়ী ভাষার ভিত্তিতে ভারতীয় রাজ্যগুলির সীমানাও পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এই আইন মোতাবেক বিহারের একটি অংশ পশ্চিম দিনাজপুর জেলার সঙ্গে যুক্ত হয়। ফলে জেলার আয়তন বৃদ্ধি হয়। একইভাবে ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর বিহারের মানভূম জেলার পুরুলিয়া মহকুমা একটি পূর্ণাঙ্গ জেলার রূপ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৭৬৫ সালে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। জঙ্গলমহলের এই পুরুলিয়া অঞ্চলটি জয় করতে ইংরেজদেরও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে ১৮০৫ সালে জঙ্গলমহল জেলা, পরে ১৮৩৩ সালে জেলা ভেঙে গঠন হয় মানভূম জেলা। বর্ধমান ও বাঁকুড়া জেলারও একটি বৃহৎ অংশ মানভূম জেলার অন্তর্গত ছিল। ১৯১১ সালে মানভূম বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিহারের অন্তর্গত হয়। এই মানভূমের অন্তর্গত পুরুলিয়া মহকুমা ১৯৫৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়।
২৪
পরগনা
ভেঙে
উত্তর
ও
দক্ষিণ
২৪
পরগনা
স্বাধীনোত্তর পর্বে কয়েকটি জেলা বিশেষ করে ২৪ পরগনা, পশ্চিম দিনাজপুর ও মেদিনীপুরের মতো বৃহদাকার জেলাকে ছোটো জেলায় দ্বিখণ্ডিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সরকার পক্ষ থেকে স্থির করা হয় এই জেলাগুলিকে দু'ভাগে বিভক্ত না করলে প্রশাসনের কাজের তীব্র অসুবিধা। তাই ২৪ পরগনা দিয়েই প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২৪ পরগনাকে ভেঙে ১৯৮৬ সালের ১ মার্চ উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা গঠন করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের জেলরার সংখ্যা বেড়ে হয় ১৭টি।
১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর নবাব মীরজাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনিকে ২৪টি পরগনার ভোগসত্ত্ব দেয়। সেই ২৪ টি পরগনা হল- ১) আকবরপুর ২) আমিরপুর ৩) আজিমবাদ ৪) বালিয়া ৫) বাদিরহাটি ৬) বসনধারী ৭) কলকাতা ৮) দক্ষিণ সাগর ৯) গড় ১০) হাতিয়াগড় ১১) ইখতিয়ারপুর ১২) খাড়িজুড়ি ১৩) খাসপুর ১৪) মেদনমল্ল ১৫) মাগুরা ১৬) মানপুর ১৭) ময়দা ১৮) মুড়াগাছা ১৯) পাইকান ২০) পেচাকুলি ২১) সাতল ২২) শাহনগর ২৩) শাহপুর ও ২৪) উত্তর পরগনা। সেই থেকে অঞ্চলটির নাম হয় ২৪ পরগণা। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে যশোহর জেলার বনগাঁ ২৪ পরগনা জেলার মধ্যে চলে আসে।
পশ্চিম দিনাজপুর ভেঙে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর
ইতিমধ্যে পশ্চিম দিনাজপুর জেলা আকারে-আয়তনে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই প্রশাসনিক কাজকর্ম চালানোর সুবিধার্থে এই জেলাকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রয়োজন অনুভব করে সরকার। বৃহদাকার জেলাকে ছোটো জেলায় দ্বিখণ্ডিত করার প্রক্রিয়া অনুযায়ী ১৯৯২ সালের ১ এপ্রিল উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার সৃষ্টি হয়। পশ্চিম দিনাজপুর নামের অবলুপ্তি ঘটে। উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা তৈরি হওয়ায় রাজ্যের জেলার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা জলপাইগুড়ি বিভাগের অন্তর্গত একটি জেলা। ওই জেলার দক্ষিণাংশ নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা স্থাপিত হয়। উত্তরাংশ নিয়ে উত্তর দিনাজপুর। দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলাসদর বালুরঘাট। বালুরঘাট ও গঙ্গারামপুর- এই দুই মহকুমা নিয়ে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা গঠিত। উত্তর দিনাজপুর জেলার সদর দফতর রায়গঞ্জে।
মেদিনীপুর জেলা ভেঙে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর
পাঁচ-ছ'বছরের ব্যবধানে ২৪ পরগনা ও পশ্চিম দিনাজপুর ভেঙে চারটি জেলা তৈরি হলেও। মেদিনীপুরকে ভেঙে দু'ভাগে ভাগ করার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব ঘটে। দশ বছর পর ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি মেদিনীপুর দ্বিখণ্ডিত করে গঠিত হয় পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সদর দফতর হয় তমলুক। আর পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সদর দফতর হয় মেদিনীপুর। মেদিনীপুর জেলা সদর হিসেবে প্রস্তুত ছিলই। তমলুককে মহকুমা দফতর একে সদর দফতের পরিণত করা হয়। মেদিনীপুর জেলার দ্বিখণ্ডন প্রক্রিয়ার সমাধা হলে পশ্চিমবঙ্গ পায় ঊনিশ তম জেলা।
এই জেলার অনেকাংশ তাম্রলিপ্ত সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। ১০২১-১০২৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা রাজেন্দ্র ঢোলের আক্রমণের পর তাম্রলিপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হয়। এরপর ১১৩৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা অনন্ত বর্মন মেদিনীপুরের দখল নেন। ১৫০০ শতাব্দীর শুরুতে মেদিনীপুর মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মেদিনীপুরের একাংশের দখল নেয় মারাঠারা।
জলপাইগুড়ি ভেঙে জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার
জলপাইগুড়ি জেলাকে দু'ভাগ করে তৈরি হল আলিপুরদুয়ার। এটি রাজ্যের বিংশতিতম জেলা। ২০১৪ সালের ২৫ জুন থেকে রাজ্যে নতুন জেলা হিসেবে যাত্রা শুরু করে আলিপুরদুয়ার। জলপাইগুড়ি সদর আর মালবাজার মহকুমা নিয়ে হয় জলপাইগুড়ি জেলা। সাবেক আলিপুরদুয়ার মহকুমা যায় আলিপুরদুয়ার জেলায়।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, আলিপুরদুয়ারের মানুষ বহু দিন থেকেই আলাদা জেলা চাইছিলেন। মানুষের সেই দাবি মেনেই জলপাইগুড়ি ভেঙে আলিপুরদুয়ারের জন্ম। তিনি বলেন, জলপাইগুড়ি জেলা দু'ভাগে ভাগ করা হলে সাধারণ মানুষের লাভ হবে এবং প্রশাসন জনগণের আরও কাছে যেতে পারবে। তৃণমূল সরকার এই জেলা বিভাজন করায়, সিপিএমের তরফে দাবি করা হয় রাজনৈতির স্বার্থ চরিতার্থ করতেই এই জেলা বিন্যাস করা হয়েছে।
সবশেষে দার্জিলিং ভেঙে কালিম্পং
এ
মাসেই
রাজ্যের
২১তম
জেলা
হিসেবে
পথ
চলা
শুরু
করেছে
কালিম্পং।
পাহাড়
পেয়েছে
নতুন
জেলা।
মুখ্যমন্ত্রী
মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের
হাত
ধরে
কালিম্পং
দার্জিলিং
থেকে
বিচ্ছিন্ন
হয়ে
পূর্ণাঙ্গ
জেলার
মর্যাদা
পেয়েছে।
ভালোবাসার
দিনেই
বিচ্ছিন্ন
হয়েছে
দার্জিলিং
ও
কালিম্পং।
কালিম্পং-এ
সভা
করে
সরকারিভাবে
পৃথক
কলিম্পিং
জেলা
গঠনের
কথা
ঘোষণা
করেছেন
মুখ্যমন্ত্রী
মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়।
শুধুমাত্র
একটি
বিধানসভা
কেন্দ্র
নিয়ে
একটি
জেলা
গঠনের
কঠোর
সমালোচনা
করেছেন
সিপিএমের
রাজ্য
সম্পাদক
সূর্যকান্ত
মিশ্র।
তিনি বলেন, এই জেলার কোনও পরিকাঠামো গঠন করা হয়নি। এই মুহূর্তে এই জেলা জনগণের কী পরিষেবা দেবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। এই বিভাজনের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে তৃণমূল রাজনৈতিক ভিত্তি প্রসারিত করার উদ্যোগ নিয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ। এখন শিলিগুড়ি, ইসলামপুর, বালুরঘাটসহ নানাস্থানে নতুন জেলা গঠনের দাবি উঠেছে।
কালিম্পংয়ের মাথায় জেলার মুকুট পরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, দার্জিলিংয়ের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি কালিম্পংয়ের জন্যও অনেক কাজ করেছে সরকার। নতুন জেলা কালিম্পংও বেশ বড়। কালিম্পংকে দ্বিতীয় দার্জিলিং হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
পূর্ণাঙ্গ জেলা হচ্ছে ঝাড়গ্রাম ও আসানসোল
ঝাড়গ্রামকে আলাদা পুলিশ জেলা হিসেবে ঘোষণা করেছে তৃণমূল। আগামী মাসেই হয়তো ঝাড়গ্রাম পূর্ণাঙ্গ জেলার স্বীকৃতি পাচ্ছে। বর্ধমান ভেঙে আসানসোল জেলা করার প্রক্রিয়াও এগিয়ে গিয়েছে কালিম্পং জেলার পথ চলা শুরুর দিনই ঝাড়গ্রাম ও আসানসোল যে আগামী দু'মাসের মধ্যেই পূর্ণ জেলা হচ্ছে, তা ঘোষণা করে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের জেলার সংখ্যা দাঁড়াবে ২৩।