ওরা দৃষ্টিহীন, তবুও জীবন লক্ষ্য হারায়নি, আমাদের ভিতরের মনুষ্যত্ব ওরা বাঁচিয়ে রেখেছে!
"ধুর ও তো কানা কিছু দেখতে পাবে না....", "উফ অন্ধগুলোকে নিয়ে মহা ঝামেলা..." আরও কত বঞ্চনা, তিরস্কার জোটে হতভাগ্য দৃষ্টিহীনদের কপালে। মানুষের কাছে সম্মান পাওয়া যেন চাঁদ ধরার সামিল। তবু তাদের মুখে এতটুকু রাগ, অভিমান নেই, নেই জীবনের প্রতি হতাশা। হাসিমুখে সবার বঞ্চনা গিলে চলা অবিরত। আজ আমরা এমনই একটি দৃষ্টিহীন স্কুলের পড়ুয়াদের কাহিনী পাঠকদের কাছে তুলে ধরব যারা নিজের নিষ্পাপ সারল্য দিয়ে আমানবিক এই সমাজকেও আবেগের পরশে জড়াতে পারে।
দৃষ্টিহীন স্কুলের ভলিন্টিয়ার হওয়ার সূত্রে নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন দিব্যা। স্কুলের তরফে প্রত্যেক মাসে বিশেষ এই পড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন হেরিটেজ সাইটে। কোথায় তাদের নিয়ে যাওয়া হয় তাতে তাদের কিছু এসে যায় না। ঘুরতে যাওয়ার নামেই চোখে মুখে শুধুই অনাবিল আনন্দ।
এবারের যাত্রা ছিল বেঙ্গালুরুর লালবাগ। প্রায় ৪০ একর জায়গা জুড়ে ফুলের চাদরে ঢাকা এই বাগান। গাছ কোথাও আকাশ ছুঁই ছুঁই কোথাও আবার আবার মাটিতে মাথা নুইয়ে দিয়েছে। ওই এলাকার মধ্যিখানেই একটা ছোট পাহাড়। যেখান থেকে বেঙ্গালুরুকে আরও পরিষ্কার দেখা যায়। ঠিক হয়েছিল সেই পাহাড়েই চড়া যাক। দৃশ্যত ওই ছোট ছেলেমেয়েরা খুব একটা এনজয় না করলেও এই পরিবেশ তাদের কাছে এক অন্যরকমের আবেশ বয়ে আনবে।
এই আশা নিয়েই ছোট ছোট দৃষ্টিহীন শিশুদের নিয়ে ভ্য়ান থেকে নেমে পরা। গেটের সামনেই একটি আইসক্রিমের গাড়ি। আইসক্রিম ওয়ালা অত বাচ্চা দেখে উৎফুল্লের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, কারও কোনও আইসক্রিম চাই কি না। ভলিন্টিয়ার না বলাতেও আইসক্রিমওয়ালা জোরজার করতে লাগলেন। "সকাল থেকে একটাও আইসক্রিম বিক্রি হয়নি..." ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনও মতে বাচ্চাদের নিয়ে ওই আইসক্রিমওয়ালাতে এড়িয়ে এগিয়ে গেলেন ভলিন্টিয়ার।
ভলিন্টিয়ারের কথায়, "আমি ভেবেছিলাম পাহাড়ে চড়াটা বেশ কঠিন হবে এই প্রতিবন্ধী শিশুদের। প্রচন্ড হাওয়া দিচ্ছিল, তার ওপর পায়ে সাধারণ চটি, এবড়ো খেবড়ো রাস্তা, তাই সবাইকে বলেছিলাম একে অপরের হাত ধরে সাবধানে চলতে। সব বাধা পেরিয়ে আমাদের ৬ শিশুর টিম পাহাড়ে চড়তে সফল হল।"
ভলিন্টিয়ার দিব্যার কথায়, "নামার সময় ভেবেছিলাম ওঠার চেয়েও বেশি সমস্যা হবে।" কিন্তু বাচ্চারা হয়তো মাথায় অন্যকিছুই ভেবে রেখেছিল। নামার কথা শুনতেই দৌড়ে নিচে নামতে শুরু করল তারা। কিছুতেই আটকাতে পারছিলাম না ওদের। কিন্তু একটি মেয়ের চটি পিছলে পড়ে যাওয়াতেই থামতে হল ওদের। আমার গলার আওয়াজ ওদের কানে যাচ্ছিলই না। তবু কোনও মতে সবাইকে নিয়ে নিরাপদেই নেমেছিলাম পাহাড় থেকে।
পাহাড় থেকে নেমে ফের ভ্যানে চড়ার পালা। দিব্যা জানালেন। ভ্যান পর্যন্ত রাস্তাটা যে এত আবেগঘন হয়ে পড়বে তা বুঝতেও পারিনি। ভ্যানের দিকে যেতে যেতে কী হল জানালেন দিব্যা। ভ্যানের দিকে যেতে গিয়ে এক ব্যক্তি আমায় দাঁড় করাল। গলায় পোলারাইড ক্যামেরা ঝুলছে। আসলে তিনি ফটোগ্রাফার। লালবাগে ঘুরতে আসা পর্যটকদের ছবি তোলেন।"
"আমি অবাক হয়ে গেলাম যখন আমার হাতে ২০০ টাকা গুঁজে দিলেন জোর করে। আমি জানতে চাইলাম কিসের টাকা? উনি হেসে আমায় বললেন, টাকা দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও ভাবেই তিনি ওই ছোট ছেলেমেয়েগুলিকে সাহায্য করতে তো পারবেন না। তাই সাহায্যার্থে নিজের সেদিনের উপার্জনেক ১০০০ টাকা থেকে ২০০ টাকা দিয়ে দিলেন ছোট মুখগুলোয় হাসি ফোটাতে। আমি তো সত্যিই এই 'ব্যবসায়ী' ফোটোগ্রাফারদের থেকে একশো দুরে থাকতাম। ভাবতাম এরা সবসময় জোর জার করে ছবি তুলে হাতে ছবি গুজেই টাকা চায়। কিন্তু এই ফটোগ্রাফার বন্ধু আমার সেই ভুল ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে।"
নিজেকে একটু সামলে নিয়েই দিব্যা ঘুরে দেখলেন তাঁর দৃষ্টিহীন স্কুলের সব ছেলে মেয়েদের হাতেই আইসক্রিম। কী হল প্রথমটায় বুঝতে পারেননি দিব্যা। কিছুটা চমকে গেছিলেন এতগুলি আইসক্রিমের দাম দেওয়ার মতো টাকা তো তার হাতে নেই এখন। তারপর বুঝলেন ঢোকার মুখে যে আইসক্রিমওয়ালা বউনি না হওয়ার দোহাই দিয়ে টাকার বিনিময়ে আইসক্রিম গছানোর যারপর নাই চেষ্টা করেছিলেন, সেই আইসক্রিমওয়ালাই বিনামূল্যে বাচ্চাদের হাতে আইসক্রিম তুলে দিয়েছেন নিঃস্বার্থ হয়েই।
দিব্যার কথায়, "আমি হতবাক হলাম। গালে যেন একটা সপাটে চড় খেলাম। আমি এদের সবসময় ভাবতাম এরা টাকা ছাড়া কিছু বোঝেনা। দাম বাড়িয়ে চড়িয়ে খাবার গছিয়ে পয়সা কামায় শুধু। আমি একেবারে ভুল। প্রায় ১৪০০ টাকার আইসক্রিম বিমামূল্যে ছেলেমেয়েগুলির হাতে তুলে দিয়েছিলেন ওই আইসক্রিমওয়ালা। একটা পয়সাও নেননি তিনি। সেদিন বুঝেছিলাম দৃষ্টি হারিয়ে ওরা খুশি থাকতে জানে, লোককে খুশি রাখতে জানে। বঞ্চনাকে হাসি দিয়ে জয় করতে জানে। মনুষ্যত্ব হারায়নি এই সব খারাপের দুনিয়াতেও ওরা আমাদের ভিতরের মানুষকে বাঁচিয়ে তুলতে জানে।"