তাইল্যান্ডের রাজা ভুমিবল অদুল্যাদের মৃত্যু যেন মহাভারতের ভীষ্মের মহাপ্রয়াণ
উননব্বই পূর্ণ করতে আর দু'মাসও ছিল না ৷ তার আগেই, অক্টোবর-এর ১৩ তারিখে শেষ নিঃশেষ ত্যাগ করলেন তাইল্যান্ডের রাজা ভুমিবল অদুল্যাদে৷ দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন তাইল্যান্ডের জনপ্রিয় এই নৃপতি৷ একটানা সত্তর বছর রাজত্ব করে (স্বাধীন ভারতের বয়সের চেয়েও বেশি) অবশেষে এই ধরাধাম ত্যাগ করলেন তিনি৷ তাইল্যান্ডের স্থিতিশীলতার প্রতীক রাজা অদুল্যাদেজ-এর এই মৃত্যুতে স্বভাবতই শোকস্তব্ধ সমগ্র তাইল্যান্ডবাসী৷
রাষ্ট্রীয় শোক তো যেমন চলার চলবে, কালের নিয়মে আবার সবাই শোক কাটিয়েও উঠবেন, কিন্তু অদুল্যাদের পরে কে? এই প্রশ্নটাই এখন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটির সকল নেতা এবং নাগরিকের মনে দৃঢ় আকার নিচ্ছে৷ এমনিতে তাইল্যান্ডের রাজবংশ সম্পর্কে চর্চা সম্পর্কে কড়া আইন চালু থাকায় কেউ (সেদেশের সংবাদমাধ্যমও) প্রকাশ্যে বিশেষ কিছু বলছে না ঠিকই, কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে সবাই উদ্বিগ্ন, তা বোঝা যাচ্ছে৷
সামরিক শাসনের সময়ে রাজার মৃত্যু; তাইল্যান্ড এবার কোন দিশায় যাবে?
অদুল্যাদেজ-এর যখন মৃত্যু ঘটল, তখন তাইল্যান্ডের রাজনীতি একটি অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে৷ তাইল্যান্ডে এখন সে-দেশের প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষ এবং প্রধানমন্ত্রী জেনারেল প্রায়ুৎ চান-ওচা-র নেতৃত্বে মিলিটারি জুন্টার শাসন৷ অতএব, সেখানকার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ঠিক কোন পথে এগোবে, তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত সব মহলই৷ সাময়িকভাবে হয়তো অদুল্যাদেজ-এর মৃত্যুর কারণে রাষ্ট্রীয় শোকের সময়সীমা বাড়ানো হবে যাতে সব পক্ষই পরবর্তী পরিকল্পনার সময় পায় (১৯৯৫ সালে যখন প্রয়াত রাজার মা মারা যান, তাঁর শেষকৃত্য করতে তাইল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ আট মাস সময় নেন!)
তবে অতিরিক্ত কালহরণ আবার তাইল্যান্ডের মতো পর্যটন-নির্ভরশীল অর্থনীতির পক্ষেও খারাপ হতে পারে৷ তাই, আগামী দিনগুলিতে তাইল্যান্ডের শাসকদের যে যথেষ্ট হিসেবে করে পা ফেলতে হবে, তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না৷
পরবর্তী রাজার কি সেই নৈতিক জোর থাকবে? উঠছে প্রশ্ন
তাইল্যান্ডের রাজনীতির ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই নির্ভর করছে পরবর্তী যিনি রাজা হবেন, সেই অদুল্যাদের পুত্র মহা ভাজিরালংকর্ন তাঁর প্রয়াত পিতার মতো তাইল্যান্ডের জনমানসে প্রভাব ফেলতে পারেন কিনা, তার উপর৷ যদিও প্রয়াত রাজার মতো তাঁর প্রভাব তাঁর উত্তরসূরির নেই, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ওচা-এর ঘোষণা অনুযায়ী সিংহাসনে অদুল্যাদের উত্তরসূরি পূর্বপরিকল্পনামাফিকই তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন৷ অর্থাৎ, সামরিক শাসকরা এই ব্যাপারে কোনও কথা বলতে চান না৷ তাইল্যান্ডের রাজপদের প্রতি সেদেশের প্রজাদের যে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা, তার মধ্যে রাজনৈতিক মহল কোনও হস্তক্ষেপ চায় না৷
তাইল্যান্ডের রাজা তো সর্বেসর্বা নন, তাহলে তাঁকে নিয়ে এত আলোচনা কেন?
কিন্তু তাইল্যান্ডের রাজা তো সর্বেসর্বা নন, তাহলে তাঁর ভূমিকা নিয়ে এত আলোচনা কেন? আসলে তাইল্যান্ডে গণতন্ত্রের যাত্রায় এতবার প্রতিঘাত নেমে এসেছে (১৯৩২ সাল থেকে মোট বারো বার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে সে-দেশে) যে জাতীয় সঙ্কটের সময়ে রাজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছেন৷
রাজা অদুল্যাদে সবসময়ে দেশের মানুষের কাছে অভিভাবকের মতো থেকেছেন
রাজার সিংহাসনের নৈতিক কর্তৃত্ব দেশের সামরিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রগুলির থেকে বরাবরই উপরে থেকেছে৷ প্রয়াত রাজা অদুল্যাদেজ তাঁর সুদীর্ঘ শাসনে অনেকবারই তাইল্যান্ডের রাজনৈতিক সঙ্কটের সময়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, দেশবাসীকে স্থিতিশীলতার ভরসা দিয়েছেন৷ তাই আজ তাঁর অভাব চটজলদি পূরণ হওয়া বেশ কঠিন৷
তাছাড়া, রাজসিংহাসনের সঙ্গে তাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনীর সম্পর্কও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল বরাবর৷ অতীতে যে ক'বার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে তাইল্যান্ডে, প্রতিবারই রাজার একটি প্রাসঙ্গিকতা ছিল৷ বলা হয়, তাইল্যান্ডের সামরিক নেতৃত্বের প্রথম আনুগত্য রাজার প্রতি, তারপর সেখানকার জনগণের প্রতি৷
তবে ২০১৪ সালে শেষ যেবার অভ্যুত্থান ঘটে তাইল্যান্ডে, সেবার হয়তো রাজার প্রাসঙ্গিকতা আর অতটা বেশি ছিল না, কারণ অদুল্যাদেজ-এর বয়স এবং ভগ্নস্বাস্থ্য৷ অর্থাৎ, বর্তমান মিলিটারি শাসকরা এখন তাইল্যান্ডের ভঙ্গুর গণতন্ত্র এবং দুর্বলতর রাজসিংহাসনের তুলনায় ক্ষমতার প্রভাবে অনেকটাই এগিয়ে৷আর অদুল্যাদের মৃত্যুতে বলা চলে সেই ক্ষমতার ভারসাম্য অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেল৷ এখন পরের রাজা কী করেন, সেটাই দেখার৷ আর প্রধানমন্ত্রী ওচা-র সঙ্গে ভাজিরালংকর্ন-এর সম্পর্ক অতীতে খুব মসৃণ ছিল না, অতএব...
অদুল্যাদেজ-পরবর্তী রাজপ্রতিষ্ঠানটিও কি বদলে যাবে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, অদুল্যাদের মৃত্যু তাইল্যান্ডের রাজসিংহাসনের ভবিষ্যৎটাই বদলে দিতে পারে৷ গত সত্তর বছরে একই ব্যক্তি রাজসিংহাসনে আসীন থাকাতে সে-দেশের তৃণমূল স্তরে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের দিকে হয়তো বিশেষ মনোনিবেশ কেউ করেনি৷ব্যক্তি অদুল্যাদেই তাঁদের কাছে প্রধান ছিল৷ কিন্তু এখন তাঁর উত্তরসূরির জমানায় সেই বদলে যাওয়া তাইল্যান্ডের গুরুত্ব আরও বাড়ার প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে৷
গণতন্ত্র এখনও পায়ের তলায় শক্ত জমি না পেলেও তাইল্যান্ডে যে বিপুল অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে এবং সেখানকার অর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনে যে টানাপড়েনের সৃষ্টি হয়েছে, তা সামরিক শাসনের যুগে কোনদিকে দেশটিকে নিয়ে যেতে পারে এবং এই সমস্ত ঘটনার ঘনঘটায় অদুল্যাদে পরবর্তী নৃপতিদের কি ভূমিকা থাকবে, সে-সব বিষয় এখন দেশের মধ্যে এবং বাইরে থাকা তাইল্যান্ডের মানুষকে যে নিঃসন্দেহে ভাবাবে, তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই৷