শিল্প-স্বপ্নের অপমৃত্যুতে বাংলার লগ্নি-সম্ভাবনায় সিঙ্গুর ভাল বিজ্ঞাপন নয়
শিল্পসম্ভাবনার জমিতে কৃষির নবজন্ম হল ঠিকই, কিন্তু এক বহুলালিত সুখস্বপ্নের অপমৃত্যু হল একইদিনে। দশ বছরের আন্দোলনে মুছে গেল শিল্পের শেষ চিহ্নটুকুও।
শিল্পসম্ভাবনার জমিতে কৃষির নবজন্ম হল ঠিকই, কিন্তু এক বহুলালিত সুখস্বপ্নের অপমৃত্যু হল একইদিনে। দশ বছরের আন্দোলনে মুছে গেল শিল্পের শেষ চিহ্নটুকুও। শিল্পের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে কোজাগরীর পরে সত্যিই কি 'লক্ষ্মীলাভ' হল সিঙ্গুরের? কংক্রিটের গাঁথুনি সমূলে উপড়ে ফেলে সেই জমিতে বীজ পুতে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। কিন্তু রেখে গেলেন অনেক বিতর্ক। কোনও সন্দেহ নেই তিনি রাজনৈতিকভাবে জয়ী হলেন। কিন্তু সিঙ্গুরের এই 'পিছু হাঁটা' রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনার ক্ষেত্রে কি ভালো বিজ্ঞাপন হয়ে থাকল!
কৃষির নবজন্ম হোক বা শিল্প-স্বপ্নের অপমৃত্যু। বিতর্ক কিন্তু রয়েই গেল। সেই বিতর্ক আজীবন খোঁচা দিয়ে যাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে। টাটা প্রকল্পের শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলতে গিয়ে কত টাকা খরচ হল, রাজ্যকে কতখানি দেউলিয়া করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তার হিসেব দিতে হবে না? বিরোধীরা আজ ভঙ্গুর, শক্তিহীন। তাই হয়তো মুখে কুলুপ দিয়ে রয়েছে। কিন্তু একদিন তো আসবেই, যেদিন হিসেব চাইবে বাংলার মানুষ। কী জবাব দেবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
বিশাল একটা এলাকাজুড়ে টাটা প্রকল্পের কারখানা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আজ দীর্ঘ ১০ বছর ধরে। মমতার আন্দোলনের জেরে টাটা-রা বাংলাছাড়া হতে বাধ্য হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সিঙ্গুরের ট্রেডমার্ক হয়ে উঠেছিল ওই কারখানা। সিঙ্গুর বোঝাতে টাটার ন্যানো প্রকল্পের নাম সবার জিভের ডগায় চলে আসত। তবু এতদিন যে সুবিশাল কারখানা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, মানুষের মনের কোণে কোথাও একটা সম্ভাবনার রেখাও উঁকি দিচ্ছিল। টাটার মতো বড় প্রকল্প না হলেও, ছোটোখাটো কোনও প্রকল্প ওই এলাকায় হতে পারে অনিচ্ছুকদের জমি ফেরত দিয়েও। সেই স্বপ্নের অপমৃত্যু হল এবার।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো তখনও প্রস্তাব দিয়েছিলেন সিঙ্গুরে শিল্প হোক অনিচ্ছুকদের জমি ফেরত দিয়ে। বিরোধী আন্দোলনে যখন উত্তাল সিঙ্গুর, আলিপুরের প্রশাসনিক ভবনে বৈঠকে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তথা তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কৃষি বাঁচিয়ে শিল্পের পক্ষপাতীই ছিলেন। বরং তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেববাবু ৯৯৭ একর জমিতেই শিল্প গড়ার ব্যাপারে গোঁড়ামিতে আটকে ছিলেন। কিছুতেই সেই অবস্থান থেকে তিনি বেরিয়ে আসেননি।
অথচ এক-তৃতীয়াংশ কৃষক অনিচ্ছুক ছিলেন মাত্র। অর্থাৎ শিল্পের জন্য ছ'শো একরের অধিক জমি পাওয়া যেত। ভাবনা-চিন্তা করলে হয়তো টাটাকেও ফিরে যেতে হত না। সিঙ্গুর আজ অন্য রূপে প্রতিভাত হত। আর সবথেকে বড় কথা বাংলা থেকে বামফ্রন্ট সরকারকে এভাবে ঘাড়ধাক্কা খেতেও হত না। মুছে যেতে হত না কমিউনিস্ট পার্টিকে। এখন প্রশ্ন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন কৃষি বাঁচিয়ে শিল্পের পক্ষে ছিলেন, তখন জমি ফেরতের ঐতিহাসিক সুপ্রিম-আজ্ঞার পরও তো সেই ভাবনা অনুযায়ী কাজ করতে পারতেন। কিংবা সরকারে আসার পর যে জমি ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেটাও তো ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক চাষিদের কথা ভেবেই দিতে পারতেন।
অর্থাৎ যাঁরা অনিচ্ছুক তাঁদের জমি ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে। যাঁরা ইচ্ছুক তাঁদের জমিতে শিল্প হবে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে, সেক্ষেত্রে যাঁর জমি যেখানে ছিল, সেই জমি-ই ফিরিয়ে দেওয়া যেত না। মুখ্যমন্ত্রী এতবড় কর্মকাণ্ড করতে পারলেন, আর ওইটুকু প্রভেদ করতে পারতেন না। এখনও অনেক জমির মালিক চান সিঙ্গুরে শিল্প হোক। তাহলে আজ শিল্পের সম্ভাবনাকে একেবারে পিষে মেরে ফেলে কি বাংলাকে সঠিক দিশা দেখালেন বাংলার উন্নয়নের কাণ্ডারি? এ প্রশ্ন কিন্তু রয়েই যাবে?
এরপরও হয়তো শিল্প হবে। কর্মসংস্থান হবে। বাংলা এগোবে। কিন্তু এই শিল্প-উপড়ে ফেলার খোঁচা তাঁকে চিরকাল শুনতে হবে। কংক্রিটের কারখানার একের পর এক 'পাঁজর' উপড়ে ফেলা সময় কি একবারও মনে হয়নি প্রতিবারই শিল্পসত্তায় আঘাত লেগেছে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গিয়েছে শিল্পোদ্যোগের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনটি। ডিনামাইট বা ল্যান্ড মুভারের প্রতিটি আঘাত কি সিঙ্গুর তথা বাংলার মানুষের স্বপ্নকে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে দিচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী কি সেই যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারেননি? হয়তো পারেননি। হয়তো পেরেছেনও। কিন্তু তাঁর কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার বিষয়টাই।
কী স্বপ্নই না দেখেছিল সিঙ্গুর! সেই দশ বছর আগে ২০০৬ সালে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গড়াবে ন্যানোর চাকা। স্বপ্নপূরণে ধানের জমি ফুঁড়ে উঠেছিল কংক্রিটের গাঁথুনি। আজ সেই কংক্রিটকে ধূলিসাৎ করে শিল্পায়নের শেষ প্রদীপটুকুকেও নিভিয়ে দেওয়া হল। এখন ধূ-ধূ প্রান্তরে শুধু লক্ষ্মীলাভের জয়গান। দশ বছরের প্রতীক্ষার অবসানে কষ্টের দিনশেষে খুশির হাওয়া। কোজাগরীর পর লক্ষ্মীলাভের আনন্দে মাতোয়ারা গোটা সিঙ্গুর মুখরিত আনন্দের জয়গানে। দুর্গোৎসবের পর সিঙ্গুর-উৎসব। আনন্দ-উচ্ছ্বাসে ভাসছে উর্বর সিঙ্গুর। কিন্তু সত্যিই কি সমস্ত যুবসম্প্রদায়ের মন হাসতে চাইছে?