কলম্বিয়াতে ব্রেক্সিটের ছায়া; মানুষ ছুঁড়ে ফেললেন কষ্টার্জিত শান্তিচুক্তি
গণতান্ত্রিক পৃথিবীতে জনগণের ইচ্ছেই শেষ কথা, আর বিশেষ করে আজকের দুনিয়াতে তো বটেই। এই কয়েকমাস আগে ব্রেক্সিট পর্বে দেখা গেল ব্রিটেনের জনগণ গণভোটে রায় দিলেন যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে আর থাকা চলবে না। দেশের প্রথম সারির নেতৃত্বকেও তা মেনে নিতে হল এবং ব্রিটেন এখন তৈরী হচ্ছে ইইউ-পরবর্তী যুগের জন্য।
এইরকম একটা পরিস্থিতি এবার দেখা গেল দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়াতে। সে-দেশের সাধারণ মানুষ সাম্প্রতিককালে সেখানকার সরকার এবং গেরিলা গোষ্ঠী ফার্ক-এর মধ্যে হওয়া শান্তিচুক্তি প্রত্যাখ্যান করলেন। বাহান্ন বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে ইতি ডাকল যে চুক্তি, তা আম কলম্বিয়ানরা গ্রহণ করতে গররাজি হলেন?
কলম্বিয়াই ছিল শেষ দেশ যেখানে সশস্ত্র বিপ্লবের ট্র্যাডিশন এতদিন বজায় ছিল। অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে যে-দেশের সাধারণ মানুষ ক্রমাগত ভুগেছে রাজনৈতিক টানাপড়েনে, সে-দেশ তবে কেন এই কষ্টার্জিত শান্তিচুক্তিকে মেনে নিতে পারলেন না?
কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি ইউয়ান ম্যানুয়েল স্যান্টোস বরাবরই চেষ্টা করে আসছিলেন ফার্ক-এর সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার। চার বছর আগে দুই পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয় এবং শেষ অবধি এই বছরের অগাস্ট মাসে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তিতে হিংসা বর্জন, ফার্ক-এর রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি, গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন, মাদক ব্যবসার অন্ত এবং অপরাধীদের প্রতি 'সুবিচার'।
অপরাধীদের "ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে!"; গর্জে উঠল সাধারণ মানুষ
আর জনগণের আপত্তি উঠে আসে ওই শেষ প্রশ্নটিতেই। শান্তিচুক্তি মাফিক, সংঘর্ষের দিনগুলিতে যাঁরা হিংসা, খুন সহ নানা অপরাধের জন্য দায়ী ছিলেন, তাঁরা যদি নিজেদের দোষ স্বীকার করে নেন, তাহলে তাঁদের আর জেলের হাওয়া খেতে হবে না। তাঁরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে শ্রমদান করে নিজেদের দোষের প্রায়শ্চিত্ত করবেন। আর এটাই কলম্বিয়ার সংখ্যাগুরু মানুষ মেনে নিতে পারেননি।
গত রবিবার (অক্টোবর ২) অনুষ্ঠিত হওয়া ওই গণভোটে (যদিও ভোটার হার ছিল খুবই কম - মাত্র ৪০ শতাংশ) কিন্তু ৫০.২২ শতাংশ মানুষ রায় দেন শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে। তাঁদের মতে, অপরাধীরা এর ফলে সহজেই পার পেয়ে যাবে। এছাড়া ফার্ক কট্টরপন্থীরা তাঁদের পুরোনো পথ থেকে সরে এলে তাঁদের সরকারের পক্ষ থেকে মাসোহারা দেওয়ার কোথাও ওঠে। শান্তিচুক্তির বিরোধী কণ্ঠস্বর এতেও তীব্র হয়।
বলা হয়, খুনে-অপরাধীদের সরকার পুরস্কৃত করছে। প্রেসিডেন্ট স্যান্টোস যদিও মনে করেন শান্তির স্বার্থে প্রতিহিংসার বিচারকে দূরে সরিয়ে রাখা জরুরি, কিন্তু প্রাক্তন দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রপতি আলভারো উরিবে সহ অনেকেই এই তত্ত্ব মানতে নারাজ। এমনকী হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামক মানবাধিকার সংগঠনও এব্যাপারে স্যান্টোসের বিপরীত অবস্থানই নিয়েছে।
প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যামেরনের মতোই রাষ্ট্রপতি স্যান্টোসও আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে রবিবারের গণভোটে 'হ্যাঁ'-শিবিরই জিতবে কিন্তু ফলাফল বেরোনোর পর এখন কলম্বিয়ার রাজনীতিতে উলটপালট অবস্থা। স্যান্টোস যদিও এখনও শান্তির আশা ছাড়তে রাজি নন, কিন্তু এই গণভোটের পর এই সমঝোতা প্রক্রিয়া আর অতটা সহজ থাকবে না বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
কলম্বিয়ার সামনে এখন ঘোর অনিশ্চয়তা
কারণ, এক, নতুন করে আরেকটা শান্তিপ্রক্রিয়া শুরু করা এবং একই সঙ্গে মাথায় রাখা যে তা জনসাধারণের পছন্দমতো হতে হবে মোটেও সহজ কাজ নয়। গণভোটে হেরে যাওয়া শান্তিচুক্তি তৈরী করতে দীর্ঘ চার বছর সময় লেগেছিল। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে, স্যান্টোসের কাজ কতটা কঠিন। আর দুই, না-শিবির জেতার পর উরিবেও এখন শান্তিপ্রক্রিয়ার পরবর্তী অধ্যায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হতে চলেছেন। কলম্বিয়ায় পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ২০১৮তে। যদিও দু'জনের কেউই আর রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না, কিন্তু স্যান্টোসের ব্যর্থতা নিঃসন্দেহে উরিবে এবং তাঁর দলকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে।
তবে, কলম্বিয়ার এই কঠিন সময়ে একটাই আশার কথা যে সরকার এবং ফার্ক -- দু'পক্ষই এখনও আশাবাদী শান্তিচুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে।