শীলাকে আনা হয়েছে বলে রীতার রাগ তো হবেই, কিন্তু কংগ্রেসের নীতিটা কী?
রাজ্য কংগ্রেসের বড় মুখ রীতা বহুগুণা জোশী বিজেপিতে যোগ দিলেন। আর দলবদলের মুহূর্তেই তিনি কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধীকে একহাত নিলেন।
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের আর খুব বেশি দেরি নেই। কিনতু কংগ্রেসের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে নির্বাচন দেরিতে বা তাড়াতাড়িতে হলেও তাদের কিছু এসে যাবে না। কারণ, এ ম্যাচ হাতছাড়া হয়েই গিয়েছে বলে গান্ধীদের দল ধরে নিয়েছে।
আর এই 'ম্যাচ হাতছাড়া' হওয়ার অন্যতম ফল দেখা গেল বৃহস্পতিবার যখন রাজ্য কংগ্রেসের বড় মুখ রীতা বহুগুণা জোশী বিজেপিতে যোগ দিলেন। আর দলবদলের মুহূর্তেই তিনি কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধীকে একহাত নিলেন। তাছাড়া, কংগ্রেসের নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোরের কৌশলও তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না প্রথম থেকেই। তাই, উত্তরপ্রদেশের প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী হেমবতী নন্দন বহুগুণার কন্যা এবং রাজ্যের প্রাক্তন কংগ্রেস প্রধান রীতা সিদ্ধান্ত নিলেন গেরুয়া শিবিরে পা রাখার।
যদিও বিজেপি যোগ দিয়ে রীতা বলেছেন যে যেভাবে রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রসঙ্গে আক্রমণ করেন (পড়ুন "রক্তের দালালি") তা তিনি বরদাস্ত করতে পারেননি। তিনি বলেন মোদী সরকারের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সিদ্ধান্ত তাঁকে উজ্জীবিত করে এই পদক্ষেপ নিতে।
বৃদ্ধ শীলাকে এনে, রাজ্যের সংগঠক মুখ রীতাকে চটিয়ে কতটা লাভ হল কংগ্রেসের?
নতুন দলে প্রবেশ করার সময়ে তার নেতৃত্ব সম্পর্কে একটুআধটু ভালো কথা বলতেই হয় জানা কথা, কিনতু এটা অজানা নয় যে দিল্লির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতকে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করাতেই রীতা ক্ষিপ্ত। কংগ্রেস যেখানে রাজ্যের ব্রাহ্মণ ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করতে শীলাকে উড়িয়ে এনেছে, সেখানে ঘরের ব্রাহ্মণ মুখ রীতার রাগ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কিনতু এই অধ্যায়টি এটাই দেখাল যে কংগ্রেসের নীতিতে কোনও ধারাবাহিকতা নেই। যে দল গত চার-পাঁচ দশক ধরে একটি পরিবারকেই তার ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল হিসেবে দেখে এসেছে, সেই দলই স্থানীয় পর্যায়ে কিনতু এই পরিবারতন্ত্রকে হেয় করেছে।
রীতা তাঁর প্রয়াত পিতার মতো জননেতা না হলেও এলাহাবাদ এবং তার আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে যথেষ্ট প্রভাবশালী নেতা। সংগঠক হিসেবেও ওঁর সুনাম রয়েছে। কিনতু কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব আঞ্চলিক গণতন্ত্রকে নেহরু-পরবর্তী সময়ে আর কোনওদিনই গুরুত্ব দিতে রাজি হননি।
আর তাতে দলের শিকড়ে আরও কুঠারাঘাত করে তাকে দুর্বল করা হয়েছে এবং একসময়ের মহীরুহের পতনের ফলে অন্যান্য আঞ্চলিক দল তার জায়গা নিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে থেকে এই কেন্দ্রিকতার প্রবণতা কংগ্রেসকে দীর্ঘমেয়াদে যে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তার প্রমাণ আজ পাওয়া যাচ্ছে।
অথচ বৃদ্ধ শীলাকে না এনে যদি রীতাকেই কংগ্রেস তাদের মুখ করত এই নির্বাচনে, বিরাট কিছু হারানোর থাকতো না। এখন যা হল, তাতে শীলার নিশ্চিতভাবে পাওয়া ভোটগুলিকেও রীতা ভাঙিয়ে বিজেপিতে নিয়ে যেতে পারেন। তাতে প্রশান্ত কিশোরের কৌশল কতটা উপকৃত হবে তা বলা মুশকিল।
অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশেও একইভাবে জগনকে চটিয়েছিল কংগ্রেস
কংগ্রেসের এই একই কৌশল দেখা গিয়েছিল অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে -- সে-রাজ্যের জনপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী রাজশেখর রেড্ডির দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর। তাঁর ছেলে জগন মোহনের ইচ্ছে ছিল যে প্রয়াত বাবার উত্তরসূরি হিসেবে কংগ্রেস নেতৃত্ব তাঁকেই মেনে নেবে কিনতু বাস্তবে তা হয়নি। এর ফলে অন্ধ্র রাজনীতিতে তোলপাড় দেখা দেয় আর জগন মোহন নিজের দল ওয়াইএসআর কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা করেন।
অতএব, কংগ্রেস মৌলিক অর্থে পরিবারতন্ত্র বিশ্বাসী হলেও পরিবারতন্ত্রের সংঘাতে কিনতু সে বেছে নেয় কেন্দ্রীয় পরিবারটিকেই। দেশের অন্যান্য প্রান্তের পরিবারবাদ খুব একটা গুরুত্ব পায় না (মালদার গনিখানের উত্তরসূরিরা অবশ্য এখনও একসঙ্গে রয়েছেন, তবে প্রান্তিক রাজনীতিতেই তাঁদের অবস্থান)।
তবে কংগ্রেস এই 'নিয়ম'-এর ব্যতিক্রম করেও দেখিয়েছে।
অসমে কংগ্রেস আবার স্থ্যনীয় পরিবারকে সমর্থন জানিয়েছে, কিনতু ফল গিয়েছে বিপক্ষেই
অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ-এর বিস্বস্ত সেনাপতি হিমন্ত বিশ্ব শর্মা গতবছর অগাস্ট মাসে কংগ্রেসের সঙ্গে দীর্ঘ সম্পর্ক ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দেন। তরুণ গগৈ হিমন্তকে উপেক্ষা করে নিজের তরুণ পুত্র গৌরবকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন -- এই মর্মেই অভিজ্ঞ হিমন্তের প্রতিবাদ বলে জানায় ওয়াকিবহাল মহল।
এক্ষেত্রে কিনতু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সংগঠককে উপেক্ষা করলেন, কিনতু পরিবারতন্ত্রের পাশে দাঁড়িয়ে। এর ফলাফল অবশ্য আমরা সবাই দেখেছি এই বছর। পনেরো বছর পর ক্ষমতা থেকে ছিটকে যায় কংগ্রেস এবং হিমন্ত এবং সর্বানন্দ সোনোয়াল (এখন অসমের মুখ্যমন্ত্রী)-এর উপর ভর করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যটিতে প্রথমবার ক্ষমতায় আসে বিজেপি।
তাই 'কাজের লোক'দের কাছে না টেনে দূরে সরিয়ে দেওয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের। সেটা কি দম্ভের কারণে? অথচ, যে দল ক্ষমতাতেই নয় প্রায় কোনও জায়গায়, তার কীসের এত দম্ভ?
এই প্রশ্নের উত্তরই আপাতত কংগ্রেস খুঁজুক। যদি উত্তর পাওয়া যায়, তাহলেই তারা তাদের রাজনৈতিক অফ-ফর্ম কাটিয়ে উঠতে পারবে, নচেৎ নয়।