পার্কস্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত ধরা পড়ল: ভালো হত যদি মমতা তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসটি প্রথমে খেলতেন
বৃহস্পতিবার যখন সারা দেশে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর জঙ্গি ঘাঁটিকে ধ্বংস করে দেওয়া ভারতীয় সেনার জয়গান গাওয়া হচ্ছে, তখন পশ্চিমবঙ্গ খবরের শিরোনামে উঠে এল বেশ চুপিসাড়েই।
উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় কলকাতা পুলিশের কয়েকজন ছদ্মবেশী অফিসার হাতেনাতে ধরে ফেললেন ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটা পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণকাণ্ডের মূল অভিযুক্ত কাদের খান সহ আরও একজনকে। আলি খান নামক ওই ব্যক্তিও ওই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত। বাকি তিন জন আগেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এবং তাঁদের সাজাও ঘোষণা করা হয়েছে।
অভিযোগ, সুজেট জর্ডন নামে পার্কস্ট্রিটের এক পানশালায় আলাপ হওয়া এক মহিলাকে নামিয়ে দেওয়ার অছিলায় গাড়িতে তুলে ধর্ষণ করে কাদের এবং তার সাথীরা। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝড় বয়ে যায় রাজ্য রাজনীতিতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখন প্রথমবারের জন্যে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গদিতে একবছরও কাটাননি। সুজেট জর্ডনের এই ঘটনাটিকে তিনি 'সাজানো' বলে বিরাট বিতর্কের সৃষ্টি করেন।
শাসকদলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-নেত্রীরাও কটাক্ষ করেন সুজেটকে, পুলিশও বিশেষ সহযোগিতা করেনি বলে অভিযোগ ওঠে। এক উচ্চপদস্থ মহিলা পুলিশ অফিসারকে 'সত্য বলার' অপরাধে সরানো হয় মামলা থেকে। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে: তবে কি শাসনে এলে সবাই একই ভাষায় কথা বলে?
দুই সন্তানের মা, বিয়াল্লিশ-বছরের সুজেট কিন্তু তাতে আত্মসমর্পণ করেননি। বেরিয়ে এসেছেন সর্বসমক্ষে এবং মহিলা মানবাধিকার কর্মী হিসেবে অন্যকেও উৎসাহ জুগিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, ২০১৫ সালের মার্চ মাসে মেনিনগোএনসেফ্যালাইটিস-এ আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান, অসম্পূর্ণ থেকে যায় তাঁর লড়াই।
কিন্তু বিধাতা বোধহয় ভুলে যাননি সুজেটের কথা। আর ভোলেননি কলকাতা পুলিশের কমিশনার রাজীব কুমারও। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে যাঁর বিরুদ্ধে শাসকদলের হয়ে পক্ষপাতিত্ত্বের অভিযোগ ওঠে এবং নির্বাচন কমিশন তাঁকে অস্থায়ীভাবে সরিয়েও দেয়।
সেই সময়ে ক্ষিপ্ত মমতা এক নির্বাচনী জনসভায় অভিযোগ করে বলেন যে ভালো অফিসারদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনে জিতে এসে তৃণমূল নেত্রী রাজীব কুমারকে আবার কমিশনার করেন। সেই রাজীব কুমার সুজেট-কাণ্ডের প্রধান অভিযুক্তকে ধরার পিছনে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করার ফলে আশা করা যায়, তাঁর সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর গর্ববোধ আরও একটু বৃদ্ধি পাবে।
কাদেরের ধরা পড়ার মধ্যে দিয়ে মুখরক্ষা হয় কলকাতা পুলিশেরও। এতদিন কাদেরকে পাকড়াও না করতে পেরে তীব্রভাবে সমালোচিত এবং ভর্ৎসিত হতে হয় একসময়ের নামকরা এই পুলিশ বাহিনীকে। ছেড়ে কথা বলেনি আদালতও। শহরের পুলিশ কমিশনার নির্বাচনের পরে সমাধান না হওয়া মামলাগুলির ফাইল নিয়ে বসেন এবং কাদেরের ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ হতে তিনি তার সম্বন্ধে আধিকারিকদের কাছে জানতে চান।
তাঁরা বলেন যে অনেক চেষ্টা করেও, দেশের বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়েও কাদের এবং আলির নাগাল তাঁরা পাননি। যদিও অন্য তিনজন ধরা পরে ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক পরেই। এমনকী, কাদের বাংলাদেশ এবং নেপালে আশ্রয় নিয়েছে এমন খবর আসার পরে ইন্টারপোলের সাহায্যও নেওয়া হয়। কিন্তু তাও সাফল্য আসেনি।
অবশেষে ঘটনার পর প্রায় পৌনে পাঁচ বছর পরে গ্রেফতার হয় ওই দু'জন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মমতা প্রশাসন। সুজেট জর্ডনের ঘটনাটিকেই তৃণমূল নেত্রীর মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ বলা যায় কিন্তু নবনির্বাচিত প্রশাসনিক মাথা হিসেবে তিনি সেবার রাজধর্ম পালন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তবে, ভালো কাজের যেমন কোনো সময় হয় না, তেমনই পার্কস্ট্রিট কাণ্ডের অপরাধীকে শেষমেশ ধরতে পেরে মমতা সরকার প্রমাণ করে যে সদিচ্ছা থাকলে সবকিছুই সম্ভব। আরও ভালো হত যদি মমতা তাঁর দ্বিতীয় ইনিংসটি প্রথমে খেলতেন।
দুঃখ একটাই। সুজেট জর্ডন এই দিনটা দেখে যেতে পারলেন না।