নওয়াজ শরিফের উল্টোসুরে গান পাকিস্তানকে হতাশ করল নিঃসন্দেহে
পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এক পা এগোন তো দুই পা পিছোন।
গত সপ্তাহে তাঁর সরকার বিশ্ব রাজনীতিতে পাকিস্তানের একঘরে হয়ে যাওয়ার ঘটনায় সে-দেশের সামরিক নেতৃত্বকে সাবধান করেছিলেন বলে যে খবর পাওয়া গিয়েছিল, তাতে আশ্বস্ত হয়েছিল অনেক পক্ষই।
ভাবা গিয়েছিল, এবার শরিফ এগোচ্ছেন গুটি গুটি এবং তাঁর সঙ্গে এগোচ্ছে পাকিস্তানি গণতন্ত্রও। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে সে-দেশের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে ঠেকানোর মতো কড়া অবস্থান তিনি নিতে পারছেন। কিন্তু কিসের কী!
সামরিক কর্তাদের সঙ্গে লড়াই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে শরিফ তোপ দেগে বসলেন সিরিল আলমিদা -- পাকিস্তানের প্রথম সারির দৈনিক 'ডন'-এর সাংবাদিক যিনি সেখানকার সামরিক এবং অসামরিক নেতৃত্বের মধ্যে হওয়া সাম্প্রতিকতম সংঘাতটি জনসমক্ষে নিয়ে আসেন।
পাকিস্তানের অসামরিক নেতৃত্ব যে দুনিয়াতে ইসলামাবাদের কোনঠাসা হয়ে পড়ার কথা স্বীকার করেছে বা চিনের মতো পুরোনো মিত্র পাকিস্তানকে নীতি বদল করার পরামর্শ দিয়েছে -- তাও আলমিদার জানান।আলমিদা তাঁর 6ই অক্টবরের বিস্ফোরক প্রতিবেদনে এও বলেন যে পাকিস্তানের অসামরিক নেতৃত্ব সেদেশের মিলিটারিকে সরাসরি অভিযুক্ত করে করেছে জঙ্গিদের আড়াল থেকে মদত করার জন্য।
আর এই অমধুর কথাগুলি বেরিয়ে পড়তেই রাষ্ট্রশক্তির রোষানলে পড়েন আলমিদা। এমনকি, পাকিস্তান সরকার তাঁর দেশ ছাড়ার উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
আলমিদাকে হাতিয়ার করেই শরিফ আরও লড়তে পারতেন
অথচ, আলমিদার প্রতিবেদনের উপর ভর করে কিনতু শরিফ পাকিস্তানের রাজনীতির অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। কিনতু তাতে যা বিরোধিতার ঝড়ের সম্মুখীন তাঁকে হতে হতো, তাঁর সম্প্রতি অস্ত্রোপচার হওয়া কলজেতে বোধহয় তা নেওয়ার মতো দম ছিল না। তাই সর্বেসর্বা সেনাকে কোনঠাসা করার বদলে তাঁদেরকে খুশি রাখতেই শরিফ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং পাকিস্তানের রাজনীতি আরও একবার চক্রাকারে ঘোরার জন্যে তৈরি হল।
উরির ঘটনা শরিফের জন্যও সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিল কিন্তু তিনি পারলেন কই?
উরিতে সন্ত্রাসবাদী হানায় ১৯জন ভারতীয় জওয়ান নিহত হওয়ার পর ভারত এবং পাকিস্তানের সম্পর্কে তিক্ততা শরিফের জন্য একটি সুযোগও ছিল নিজের অবস্থান শক্ত করার। সারা বিশ্ব যখন পাকিস্তানকে রীতিমতো দুষছে সন্ত্রাসের প্রশ্নে, শরিফ তখন রাওয়ালপিন্ডিকে (পাকিস্তানি সেনার হেডকোয়ার্টার্স) আরও চাপে ফেলে দিতে পারতেন।
আলমিদার খবর অনুযায়ী, তা তিনি করেওছিলেন। কিনতু তারপর খোদ আলমিদার দিকেই বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বোঝালেন যে তাঁর খবরদারি ওই কাগজেকলমেই চলে। তার বেশি কিছু আশা করা মূর্খামি।
পাকিস্তানের গণতন্ত্র গত প্রায় এক দশক সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনও হস্তক্ষেপ প্রত্যক্ষ করেনি। বলতে গেলে, প্রাক্তন সেনানায়ক এবং প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফের উত্তরসূরিরা কখনওই পাকিস্তানের রাজনীতিতে সরাসরি আঘাত হানেননি। সামরিক কর্তারা যা কলকাঠি নেড়েছেন, সবই আড়ালে বসে।
কিনতু এই মুহূর্তে দেশের একনম্বর রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ত্ব (একসময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী বেনজির ভুট্টো মৃত, মুশারফ দেশছাড়া, ইমরান খান এখনও রাজনীতির বিশ্বকাপটা জিততে পারেননি) হওয়া সত্ত্বেও নওয়াজ শরিফ তাঁর দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করার সুবর্ণ সুযোগটি পেয়েও তা কাজে লাগাতে পারলেন না । আক্রমণ করলেন সেই গণতন্ত্রেরই একটি অন্যতম বড় স্তম্ভ -- সংবাদমাধ্যমকে। অথচ পাকিস্তানের রুগ্ন গণতন্ত্রকে সোজা করতে এই সংবাদমাধ্যমের হাতকেই শক্ত করতে পারতেন তিনি।
রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐক্যের অভাব
আসলে শরিফের এই পশ্চাদপসরণের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এই জাতীয় সংকটের সময়েও পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠেনি। যেমন, ইমরান খান এই মুহূর্তেও সোচ্চার শরিফের পরিবারের বিরুদ্ধে 'পানামা পেপার্স' কান্ড নিয়ে। তাই, রাজনীতিবিদদের মধ্যে ঐক্য গড়ে না ওঠাতে (ভারতে কিনতু প্রধানত উল্টো ছবি তার কারণ ভারতে গণতন্ত্র অনেকটা পথ পেরিয়ে এখন সাবালক) সামরিক শক্তির প্রভাব সহজে ম্লান হওয়ার নয়।
দেখেশুনে অবাক লাগে যে যে শরিফকে পাকিস্তানের জনসাধারণ ২০১৩ সালে বিপুল ভোটে জয়ী করেছিলেন আগেকার দুর্নীতিগ্রস্ত পিপিপি সরকার এবং সেনা-প্রভাবিত রাজনীতি থেকে মুক্তি পেতে, তিনিও প্রায় টলমল পায়ে দিন গুজরান করছেন।
অন্যদিকে, আড়ালে থেকেও পেশওয়ারের সেনা স্কুলে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী হানার পরে প্রত্যাঘাত করে বা করাচির মতো অশান্ত শহরকেও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এনে সেনা বুঝিয়ে দিয়েছে যে পাকিস্তানের অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান এখনও তাঁরাই। আর সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করে আরও একটি পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে শরিফ নিজেকেই আরও প্যাঁচে ফেললেন।