সার্কের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পাল্টা গোষ্ঠী? গল্পটা এগারো নম্বর ব্যাটসম্যানের দুশো হাঁকানোর মতো
ঘরে বাইরে কোণঠাসা হয়ে পড়া পাকিস্তান এখন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে পাল্টা দিতে ভাবছে একটি বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় অর্থনৈতিক গোষ্ঠী তৈরি করার কথা যেখানে চীন. ইরান এবং মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে৷ সম্প্রতি ভারত সহ আরও চারটি দেশ ইসলামাবাদে আগামী মাসে হতে চলা সড়ক সম্মেলন বয়কট করলে তা বাতিল করতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ৷
তারপর আগামী শনিবার গোয়াতে শুরু হতে চলা ব্রিকস সম্মেলনে ওই গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক দেশগুলির আলোচনার টেবিলেও ইসলামাবাদকে ডাকেনি নয়াদিল্লি৷ ক্ষিপ্ত পাকিস্তান যে এর পাল্টা পদক্ষেপ নেবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী৷ মুখে অবশ্য তারা এই নয়া পরিকল্পনাতে ভারতকেও সামিল করার করার প্রস্তাব দিয়েছে৷ তবে সে তো ছেলেভুলানো ছড়া৷
পাকিস্তানের কি আদৌ সেই নেতৃত্ব রয়েছে?
কিন্তু এই ধরনের আঞ্চলিক কূটনৈতিক প্রত্যাঘাত করার মতো নেতৃত্ব কি পাকিস্তানের আছে? প্রশ্ন সেটাই৷ সাম্প্রতিককালে নরেন্দ্র মোদী যেভাবে দুনিয়াজুড়ে ঘোরাঘুরি করে ভারতের কূটনীতিকে আরও সক্রিয় হতে সাহায্য করেছেন, নওয়াজ শরিফ কি আদৌ তা পারবেন? আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পাকিস্তান সর্বস্তরে সন্ত্রাস প্রসঙ্গে কিভাবে নাকানিচোবানি খেয়েছে; পশ্চিমি দুনিয়ার কাছে তিরস্কৃত হয়েও কোনও কার্যকরী পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারেননি শরিফ৷
উল্টে, কখনও তাঁর দূতের মুখে বলতে শোনা গিয়েছে যে আমেরিকার সেদিন আর নেই৷ আবার কখনও সেনাকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের কথাবার্তা প্রকাশ্যে নিয়ে আসার কারণে খড়গহস্ত হয়েছেন তাঁরই দেশের জনৈক সাংবাদিকের উপরে৷ তা এই টেম্পারামেন্ট নিয়ে শরিফ সাহেব কতটা ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে৷
পাকিস্তানের উপকারিতা কতটুকু?
পাকিস্তানের কোনও অসামরিক নেতৃত্ব দুনিয়া জয়ের কূটনীতি আজ পর্যন্ত দেখিয়ে উঠতে পারেননি৷ সে-দেশের যা 'দুনিয়া জয়' বা বলা চলে 'সামরিকার্থে এবং কৌশলগতভাবে আমেরিকা এবং চিন জয়' হয়েছে, তা ওই মিলিটারি শাসকদেরই আমলে৷ পাকিস্তানের ভূ-কৌশলগত গুরুত্বর ফায়দা পশ্চিম অতীতে তুলেছে পূর্বতন সোভিয়েত রাশিয়াকে আটকাতে এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব চিন লুটেছে ভারতকে দক্ষিণ এশিয়াতে ব্যস্ত রাখতে৷ এর বাইরে, কোনও বৃহত্তর মঞ্চে পাকিস্তানের আর কী উপকারিতা আছে, তা তার পুরোনো মিত্ররাও বোধকরি জানে না৷
চিনকে অন্তর্ভুক্তি করলেই কি পাকিস্তানের পোয়াবারো?
সম্প্রতি চিনের একটি রাষ্ট্রীয় দৈনিকে চায়না-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর বা সিপিইসি -- যা নিয়ে পাকিস্তানের অশেষ গর্ব, তার ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রশ্ন তোলে৷ এই মেগা প্রকল্প নিয়ে যে দুই দেশই সমস্যায় পড়তে পারে, সে প্রশ্নও তোলা হয়েছে৷ বরং বেজিংকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দিকে তাকাতে৷ এতেই পরিষ্কার, যতই মিত্রতা থাকুক, পাকিস্তানের মতিগতি চিনের নেতৃত্বকে খুব একটা আশান্বিত করে না৷ শুধু ভারতকে ঠেকাতে পাকিস্তানকে সমর্থন করে যেতে হয়, তাই করা৷
সুতরাং, এই চিনকে সঙ্গে করে নতুন গোষ্ঠী তৈরি করতে গেলে পাকিস্তান থাকবে পিছনের সারিতেই, আর চিন আধিপত্য কায়েম রাখবে৷ আর চিনকে ভারতের একনম্বরে শত্রু ভাবার কোনওই কারণ নেই৷ চিন এবং ভারত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যাকে বলে 'ফ্রেনেমি' অর্থাৎ বন্ধু এবং শত্রুর মিশ্রণ৷
মধ্য এশিয়ার নিজস্ব ভূ-রাজনীতি রয়েছে
আর তাছাড়া, বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় (পূর্ব এশিয়ার চিন, মধ্য এশিয়ার প্রজাতন্ত্রগুলি এবং পশ্চিম এশিয়ার ইরানকে নিয়ে দক্ষিণ এশীয় গোষ্ঠী তৈরি হয় কিভাবে তা পাকিস্তানই জানে) গোষ্ঠী করে ভারতকে কোনঠাসা করার কথা ভাবা নেহাতই ছেলেমানুষি৷ কারণ, ওই অঞ্চলের নিজস্ব ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে; এনার্জি পলিটিক্স রয়েছে; রাশিয়ার মতো আগ্রাসী দেশের প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে; সেখানে পাকিস্তানের ভারত-বিরোধিতা কতদূর গুরুত্ব পাবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে৷ আর অর্থনৈতিকভাবে ভাবলেও তা আদতে চিন এবং রাশিয়ার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছায়াতেই ঢেকে যাবে৷ পাকিস্তানের কপালে কিছুই জুটবে না৷
আফগানিস্তানকে টপকে গোষ্ঠী? ব্যাপারটা কি খুব সহজ?
আর তারপর আছে আফগানিস্তান এবং ইরানের প্রসঙ্গ৷এই বছরের মাঝামাঝি মোদী এই দু'টি দেশের নেতৃত্ত্বের সঙ্গেই বড় ধরণের কূটনৈতিক সাফল্য লাভ করেছেন৷ ইরানের সঙ্গে চাবাহার বন্দর এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে পরিকাঠামোগত চুক্তি সম্পাদিত করেছেন৷ আর কাবুলের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়৷আফগানিস্তান এখনও দক্ষিণ এবং মধ্য এশিয়ার সীমানায় এক বড় প্রশ্নচিহ্ন৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ যাই, কাল যাই করেও এখনও এই অঞ্চল থেকে তাঁবু গুটিয়ে নিতে পারছে না, এতটাই তার গুরুত্ব৷
সুতরাং, ইসলামাবাদ যদি নতুন করে কোনও ঝামেলা পাকানোর ফন্দি করে সেখানে, তার প্রতিক্রিয়া পড়বে বিভিন্ন মহলে, পড়বেই৷ পাকিস্তানের দুই মিত্র ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে আবার সাপে-নেউলে সম্পর্ক সুতরাং তাদের মধ্যে ভারসাম্য রাখাটাও ইসলামাবাদের জন্য জরুরি৷ অতএব, আফগানিস্তানকে টপকে আর ইরানকে সঙ্গে নিয়ে রাতারাতি বৃহত্তর দক্ষিণ এশীয় গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলা অত সহজ নয় পাকিস্তানের পক্ষে৷
পাকিস্তানের বিশ্বাসযোগ্যতা কী?
এছাড়া লাগামহীন সন্ত্রাস, ধর্মীয় কট্টরবাদ, আইনকানুনের সমস্যা, অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামোগত সমস্যা ইত্যাদি তো আছেই৷ পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে তার ভাবমূর্তি৷ যে-দেশটি আজ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনও বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্বই তৈরি করে উঠতে পারল না বা অর্থনৈতিকভাবে নজর কাড়তে পারল না; চিরকাল ভারত-বিরোধী জিগির দিয়েই ভঙ্গুর রাষ্ট্রব্যবস্থাকে জীবিত রাখল, সে ভারতের মতো উদীয়মান দেশের মোকাবিলায় পাল্টা মঞ্চ গড়তে সাফল্য পাবে, একথা শুনলে বোধয় ঘোড়াতেও হাসব৷