নির্বাচনের আর এক মাস; তাও ট্রাম্পের কেলেঙ্কারির কোনও শেষ নেই
আর একমাস আছে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের। আর এই একমাস রিপাবলিকান রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অনন্ত মহাসাগর মনে হতে পারে। গত কয়েক সপ্তাহ যাবৎ নিউ ইয়র্কের এই ধনকুবেরের কর্মফল যেন তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
ডেমোক্র্যাট প্রতিপক্ষ হিলারি ক্লিন্টনের বিপক্ষে এবারের নির্বাচনের প্রথম বিতর্কসভায় তাঁর হতাশাজনক পারফর্ম্যান্স তো বটেই, আয়কর নিয়ে নানা তথ্য ফাঁস হওয়ার পাশাপাশি প্রাক্তন ভেনিজুয়েলান বিশ্বসুন্দরীর বিরুদ্ধে মাঝরাত্তিরে টুইটারে বিষোদ্গার ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে ট্রাম্প যখন জেরবার তখনই ঘটল আরেকটি বিস্ফোরণ। আর এই সর্বশেষতম ধাক্কার জের ট্রাম্প কতটা সামলে উঠতে পারেন এবার, সেটাই দেখার।
কী সেই ধাক্কা?
২০০৫ সালে তৈরি হওয়া একটি রেকর্ড এক মার্কিন বৈদ্যুতিন মাধ্যমের ভিতর থেকে আচমকা ফাঁস করে দেওয়া হয়। তাতে প্রচ্ছন্নভাবে শোনা যায় মহিলাদের সম্পর্কে একাধিক কুমন্তব্য করতে। ট্রাম্প এও বলেন যে নিজের নামডাক থাকলে মহিলাদের সঙ্গে যা ইচ্ছে করা যায়। "ওরা তাতে কিছু মনে করে না," ট্রাম্পের বক্তব্য।
এই রেকর্ডটি ফাঁস হওয়ার কিছুদিন আগেই অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসে(এপি) প্রকাশিত হওয়া একটি প্রতিবেদনে জানা যায় ট্রাম্প কিভাবে তাঁর টিভি রিয়্যালিটি শো 'দ্য অ্যাপ্রেন্টিস' চলাকালীন মহিলাদের সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করে যেতেন দ্বিধাহীনভাবে।
এবছরের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারে ট্রাম্প এমনিতেই মহিলাদের সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন। কিনতু এই শেষলগ্নে ব্যাপারটা ক্রমেই রিপাবলিকানদের পক্ষে যে বড় বিপদের সম্ভাবনা বাড়িয়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ট্রাম্পের দল।
অবস্থা বেগতিক দেখে ট্রাম্প স্বয়ং শনিবার সকালে দুঃখপ্রকাশ করেন। বলেন এক দশক আগেকার ওই তিন মিনিটের ভিডিওটেপে তাঁকে যা বলতে শোনা গিয়েছে, তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে চেনেন তাঁরা জানেন যে আসলে তিনি ওরকম মানুষ নন। "আমি একবারও বলিনি যে আমার মধ্যে কোনও খুঁত নেই," বলেন ট্রাম্প।
এখন "মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা নিয়ে ভাবার সময়" বা "বিল ক্লিন্টনও মহিলাদের অপমান করেছেন" বা "হিলারিও অন্যায় করেছেন" ইত্যাদি নানা কথা বলে ট্রাম্প বন্দুকের নল অন্যদিকে ঘোরাতে চেয়েছেন বটে কিনতু এই সাম্প্রতিকতম কেলেঙ্কারির পরে ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস জয় কতটা সম্ভব হবে তা জানেন আমেরিকার জনগণই।
এই টেপ কেলেঙ্কারির পর রিপাবলিকানরাও লজ্জায় মুখ লুকোনোর জায়গা পাচ্ছেন না। ট্রাম্পকে দুঃখপ্রকাশের (অবশ্য ওই ভাবলেশহীন মুখে দুঃখপ্রকাশ করা কতটা আবেদন জানিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে তা তিনিই জানেন) জন্য চাপ দেওয়া ছাড়াও ট্রাম্পের বদলে দলের উপরাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী মাইক পেন্সকে উইসকনসিন প্রদেশে শনিবার অনুষ্ঠিত হতে চলা প্রচারে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিপাবলিকান অর্থাৎ জিওপি (গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি) নেতৃত্ব।
রিপাবলিকান নেতৃত্ব ছিটকে পড়ছেন এদিক ওদিক, সৌজন্যে ট্রাম্প
এমনকি মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি সভার স্পিকার পল রায়ান এবং সিনেটের মেজরিটি লিডার মিচ ম্যাকনেলের মতো শীর্ষ রিপাবলিকান নেতাও ট্রাম্পের এই বিতর্ককে ভালো চোখে দেখেননি। রায়ানের রাজ্য উইসকনসিনেই তাঁর এবং ট্রাম্পের যৌথ প্রচার হওয়ার কথা ছিল শনিবার। কিনতু এই ঘটনার পরে রায়ান তাঁর পরিকল্পনা বদলান।
মাইক পেন্স যদিও সর্বসমক্ষে ট্রাম্পের পাশেই দাঁড়িয়েছেন কিনতু মার্কিন সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে যে পেন্স নাকি ট্রাম্পকে আবেদন জানিয়েছেন আরেকটু সতর্ক এবং বিনয়ী হতে। এছাড়াও ট্রাম্পের এই কান্ডে রিপাবলিকান পার্টির অনেক নেতাই এদিক ওদিকে ছিটকে পড়েছেন। বলতে গেলে, রিপাবলিকানদের জাহাজ এখন মধ্য পারাবারে ঝড়ের সঙ্গে যুঝছে এবং ক্যাপ্টেন ট্রাম্প অবস্থা সামলাতে রীতিমতো দিশেহারা।
ট্রাম্পের কপালে এমনটাই হওয়ার ছিল
কিনতু ট্রাম্পের বেপরোয়া আচরণের যে এটাই পরিণাম ছিল, তা বলাটা অত্যুক্তি হয় না। আগাগোড়া সেলিব্রিটি হয়ে বেলাগাম জীবন কাটানো যে ট্রাম্প, অফুরন্ত ঐশ্বর্যের মাঝে বসে যিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেন, তাঁর পক্ষে এইভাবে অপদস্থ হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ চিরকাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে এসেছেন তিনি। রাজনীতিতে থাকতে গেলে যে সতর্ক জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে হয়, তা নিয়ে কোনওদিনই মাথায় ঘামাননি। তাই আজ হঠাৎ তাঁর 'ধার্মিক' দিক আবিষ্কার করার অপচেষ্টা যাঁরা করছেন, তাঁরা নেহাতই ধানের খেতে বেগুন খুঁজছেন। বেগুন সেখানে কোনওদিনই পাওয়া যাবে না, শুধু শুধুই হতাশা বাড়বে।
ট্রাম্পের আরও দুর্ভাগ্য, তিনি লড়ছেন এক মহিলার বিরুদ্ধে
ট্রাম্পের আরও দুর্ভাগ্য যে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ এক মহিলা। আর এই মহিলা সম্পর্কিত বিতর্ক যত বাড়বে, ততই ট্রাম্প আরও কোনঠাসা হবেন আর ক্ষীর খাবেন হিলারি ক্লিন্টন -- রাজনৈতিকভাবে যিনিও যে খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন তা নয়। কিনতু ট্রাম্পের পাহাড়প্রমাণ বিতর্কের পাশে তা নেহাতই তুচ্ছ মনে হচ্ছে এখন।
ট্রাম্প সম্পর্কে আগামী একমাসে যদি আরও কুরুচিকর কিছু সামনে আসে, তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। বেপরোয়া ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি যে সারাজীবনে কম 'অভিযান' চালাননি, তা এতদিনে পরিষ্কার। কিনতু দুর্ভাগ্য রিপাবলিকানদের। তাঁদের নিজেদের প্রার্থীই যে তাঁদের আর কোনদিক দিয়ে ডুবিয়ে ছাড়বেন, তা ভেবেই তাঁরা আতঙ্কিত।