রাষ্ট্রসংঘের পরবর্তী মহাসচিব গুতেরেস তো বলছেন ভালো ভালো কথা, কিনতু সফল হবেন কি?
সমকালীন বিশ্ব রাজনীতিতে শান্তির বড় অভাব। আর এই শান্তির অভাবের জন্য অনেকটাই দায়ী স্বার্থের সংঘাত। আজকের এই বহুমুখী বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র মহাশক্তিধর দেশ হলেও অন্যরা চুপচাপ মার্কিনিদের আধিপত্য মেনে নিতে রাজি নয়।
সে রাশিয়ার মতো বড় দেশের দাপুটে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই হন না কেন কিংবা পূর্ব এশিয়ার ফিলিপিন্সের 'মারমূখী' রাষ্ট্রপতি রদ্রিগো দুতার্তে। দুনিয়া জুড়ে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক ক্ষমতায়ন যতই দৃঢ় হচ্ছে, জাত্যাভিমান যত জোরালো হচ্ছে বিশ্বায়নের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, ততই সংঘাতের প্রবণতা বাড়ছে, শান্তির পথ আরও সংকীর্ণ হচ্ছে।
এইরকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনটির ভূমিকা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। যেভাবে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সাম্প্রতিক অতীতে এই সংগঠনটিকে কাঁচকলা দেখিয়ে নিজেদের পেশিশক্তি জাহির করেছে, তাতে দুনিয়াতে নৈরাজ্যবাদের ধারণাই আরও প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। রাষ্ট্রপুঞ্জ নেহাতই এক ঠুঁটো জগন্নাথ, মনে করছেন অনেকেই।
আর এই অবস্থাতে এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটির হাল ধরতে চলেছেন পর্তুগালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও গুতেরেস। বিদায়ী মহাসচিব বান কি-মুন-এর জায়গা যে তিনি নিতে চলেছেন, তা একপ্রকার পাকা। আর গুতেরেস আগাম জানিয়ে রেখেছেন যে তিনি একজন সৎ মধ্যস্থতাকারীর ন্যায় ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে চান। যদি শেষ পর্যন্ত তিনিই পদটি পান, তবে বিশ্বজুড়ে অগুনতি সমস্যার সমাধান করতে সবাইকে নিয়ে তিনি কাজ করবেন।
সাতষট্টি বছর বয়সী গুতেরেস প্রার্থীত্বের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বৃহস্পতিবার ভোটাভুটি হওয়ার কথা। আগাগোড়াই ফেভারিট থাকা এই প্রার্থীর মহাসচিব হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রসংঘের বিভিন্ন আধিকারিক। সব ঠিক থাকে চললে চতুর্থ ইউরোপীয় এবং সব মিলিয়ে নবম মহাধ্যক্ষ হিসেবে গুতেরেস আগামী বছরের শুরুতেই বান কি-মুনের থেকে কার্যভার গ্রহণ করবেন।
পাশাপাশি, এবারের নির্বাচনে একজন মহিলা মহাসচিব পাওয়া গেলেন না বলে যাঁরা হতাশ হয়েছেন, গুতেরেস তাঁদের জন্যও পরোক্ষে বার্তা পাঠিয়েছেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে রাষ্ট্রসংঘে লিঙ্গ-ভারসাম্য রাখাটা জরুরি আর তার মধ্যেই আশা দেখা যাচ্ছে হয়তো বা গুতেরেস-এর সহযোগী বা সহ মহাসচিব একজন মহিলা হবেন।
গুতেরেস এর আগে রাষ্ট্রসংঘের উদ্বাস্তু-বিষয়ক দপ্তরে এক দশক কাজ করেছেন এবং মনে করেন ওই অভিজ্ঞতা তাঁকে মহাসচিবের পদের জন্য প্রস্তুতি নিতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। তবে গুতেরেস -এর মতে দুনিয়াজুড়ে এখন নিত্যনতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে সেসব সমাধান করতে আন্তর্জাতিক দুনিয়া ব্যর্থ। এই অবস্থায় ওঁর মতে প্রয়োজন "শান্তিমূলক কূটনীতি"।
এর মধ্যে থাকবে কূটনৈতিক দৌত্য এবং সমস্যার অন্তর্গত যে বা যারা, তাদের সবাইকে নিয়ে সমাধানের পথ খোঁজা। মহাসচিবের কাজ হবে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা যার মধ্যে রাষ্ট্রসংঘের সদস্য দেশগুলি একত্রে তাদের মধ্যেকার বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে সফল হয়।
আমেরিকা-রাশিয়া, চিন-আমেরিকা বা ভারত-পাককে একসাথে নিয়ে চলা, আদৌ সম্ভব?
পদার্থবিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপক গুতেরেসের দর্শন নিঃসন্দেহে শুনতে ভালো লাগে, কিনতু বাস্তবিক সমস্যার সামনে যে শুধু কোথায় চিঁড়ে ভিজবে না, তা উনি বোধকরি ভালোই জানেন। সবাইকে একসাথে নিয়ে চলার পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে যে দারুণ তা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই, কিনতু সিরিয়া প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ চিন সাগর প্রসঙ্গে ওয়াশিংটন এবং বেজিং বা সন্ত্রাসের প্রশ্নে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ঐক্যে পৌঁছনো আদৌ সম্ভব কিনা তা সময়ই বলবে। গুতেরেসকে তার জন্য আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।