'ছাপ্পান্ন ইঞ্চি' বুকের পাটা বজায় রাখতে নরেন্দ্র মোদীকে 'মাচো' সর্দার প্যাটেলের বন্দনা করে যেতেই হবে
ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুদিনটিকে ছাপিয়ে এখন সর্দার প্যাটেলের জন্মদিন হিসেবেই বড় করে দেখা হচ্ছে ৩১ অক্টোবরকে। সর্দারের 'লৌহ' ভাবমূর্তি 'ছাপ্পান্ন ইঞ্চি' বুকের পাটার অধিকারী মোদীর প্রশাসনিক সাফল্যে প্রয়োজন
একজনের জন্মদিন আর আরেকজনের মৃত্যুদিন। দু'জনের দলও এক। কিন্তু সেই দলের অবস্থা আজ এতটাই ছত্রভঙ্গ যে বিপক্ষ এখন তারই প্রয়াত নেতা-নেত্রীদের সুবিধামতো ভাঙিয়ে খাচ্ছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং উপপ্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ব্যাপারেও তাই হচ্ছে। প্রত্যেক বছর ৩১ অক্টোবর দিনটি পালিত হয় ইন্দিরার মৃত্যুদিন এবং সর্দারের জন্মদিন হিসেবে।
কিন্তু কংগ্রেসের রাজত্বে যেমনি ইন্দিরার মৃত্যুদিনের আড়ালেই থেকে যেত সর্দারের জন্মদিন, এখন কংগ্রেস-বিরোধী নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বে ঘটছে তার উল্টোটা। এই দিনটিকে রাষ্ট্রীয় একটা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে কারণ স্বাধীনতার পরে দেশকে ঐকবদ্ধ করতে সর্দারের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। একে ইতিহাসের পরিহাস ছাড়া আর কী বা বলা যেতে পারে?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মৃত্যুর পরে সর্দারের এই 'দলবদল' কতটা উপকারে লাগছে? গত লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদীর এই প্রয়াত কংগ্রেস নেতার প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের কারণ তাও বোঝা যায়। কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্রকে পরাজিত করতে সর্দারের সাহায্য নেওয়ার কৌশল যে খুব খারাপ নয়, তা মোদীর সর্দারের বিরাট 'একতা মূর্তি' তৈরি করার সাড়া ফেলে দেওয়া উদ্যোগ দেখেই বোঝা যায়। কিনতু সেই নির্বাচন তো মোদীর বিজেপি জিতে গিয়েছে।
গান্ধীদের সেই রমরমাও তো ইতিহাস আর সেই কৌলিন্য খুব শীঘ্রই আর ফিরবে বলে মনেও হয় না। তবে কেন ৩১ অক্টোবর দিনটি পাকাপাকিভাবে প্যাটেলের চরণতলে উৎসর্গ করা?
আসলে প্যাটেলকে গ্রহণ করার মধ্যে এক ঢিলে অনেকগুলি রাজনৈতিক পাখি মারা সম্ভব। কংগ্রেসের পরিবারবাদকে কটাক্ষ করার ব্যাপার তো রয়েছেই যদিও সেই লক্ষ্য এখন অনেকটাই পূরণ হয়ে গিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর বংশধরদের ভাবমূর্তি আজকের পরিবর্তিত ভারতে অনেকটাই ম্লান।
কিন্তু প্যাটেলের গুরুত্ব মোদীর কাছে অন্যদিক থেকেও বড়, বিশেষ করে প্রশাসনিক এবং আদর্শগত নিরিখে। মোদীর কাছে সর্দারের 'লৌহমানব' পরিচয় ইন্দিরার 'দূর্গা' পরিচয়ের থেকে অনেক বড়। কারণ প্যাটেলের 'মাচো' ভাবমূর্তিকে জনসমক্ষে পুজো করলে নিজের ভাবমূর্তিটাও অনেকাংশে ফুলেফেঁপে ওঠে। আর মোদীর নিজের দলে বা বৃহত্তর গেরুয়া শিবিরে সেরকম রোল মডেল হওয়ার মতো নেতা না থাকার ফলে (আগেও না, পরেও না) মোদীকে 'ধার' করতে হয় কংগ্রেসের কাছ থেকেই।
আর মোদী -- যিনি কিনা নিজের "ছাপ্পান্ন ইঞ্চি" বুকের পাটা দিয়ে ভারতের সম্মান আগলে রাখেন প্রতিদিন, তাঁর কাছে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস থেকে যে প্যাটেলের 'লৌহ' পদ্ধতি অনেক বেশি সঙ্গত মনে হবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এর পাশাপাশি প্যাটেলের নামে 'সর্দার', তাঁর গুজরাতি পরিচয় ইত্যাদি নানা ব্যাপার তো রয়েছেই।
এই সব মিশিয়ে মোদীর ওই বিরাটাকার 'একতা মূর্তি'র মতো প্রয়াত প্যাটেলের ভাবমূর্তিকেও একটি বিশেষ ছাঁচে ফেলে তাঁর নিয়মিত বন্দনা করতে থাকলে তা আখেরে উপকার করবে মোদীর প্রশাসনিক পরিচয়কেই।
আজকের ভারতে যেখানে মহাত্মা গান্ধী স্রেফ একটি প্রতীকেই রূপান্তরিত হয়েছেন, যেখানে লোকজীবনে হিংসা বৈধতা পায় এবং অহিংসকে দুর্বলতা হিসেবে ভাবা হয়, সেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে যে নিজেকে 'শক্তের ভক্ত' হিসেবে প্রমাণ করতেই হবে, তা আর আশ্চর্যের কী। 'সার্জিক্যাল স্ট্রাইক' -এ সাফল্য পেতে গেলে প্যাটেলের মতো হতে হবে বইকি। মহাত্মা গান্ধীর মতো 'আরেক গাল বাড়িয়ে দেওয়ার' আচরণে আজকের পাবলিক বিশেষ খুশি হবে না।
অবশ্য এই প্যাটেল প্রকল্পে কিছু কিছু জিনিস ইচ্ছে করে ভুলে যাওয়াও হয়। যেমন, গান্ধী হত্যার পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে নিষিদ্ধ করেছিলেন সর্দারই। কিনতু কংগ্রেসের সেই অভ্যন্তরীণ একতা আজ নেহেরু-প্যাটেলদের উত্তরসূরিদের অপদার্থতায় আজ এতটাই লণ্ডভণ্ড যে তার সুবিধা নিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদীরা। রাজনৈতিক ইতিহাসের কী পরিহাস।