মমতার 'বাচ্চা মেয়ে' আর মুলায়মের 'ছোট ছেলেরা' ক্রমশই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ভারতের জন্য!
অনুব্রত মণ্ডল, আরাবুল ইসলামের মতো দোর্দন্ড প্রতাপ নেতাদের তো দাদাগিরি করার সার্টিফিকেট আগেই দিয়ে দিয়েছিলেম মুখ্যমন্ত্রী। এবার শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতো চোখর মণি অনুগত নেতাদের আত্মীয়স্বজনদেরও নির্ভয়ে যথেচ্ছ করার সুযোগ দিয়ে দিলেন শাসক দলের নেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কলকাতায় হিট অ্যান্ড রান মামলায় শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইঝি দেবপ্রিয়ার ড্রাইভিং লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করেন এক সৎ ট্রাফিক পুলিশ। সেটা একেবারেই ভাল চোখে নেননি মমতা দেবী। উল্টে নিজের পুলিশকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলেছেন, "রাজনৈতিক নেতাদের সবাই যেমন সৎ হয় না পুলিশের মধ্যেও তেমন ১ শতাংশ অসৎ পুলিশ আছেন।"
অর্থাৎ যে ট্রাফিক পুলিশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পাইভেট পপার্টি' হওয়া সত্ত্বেও মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ভাইজির দেবপ্রিয়ার লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করেছেন তিনি অসৎ না হয়ে যায় কোথায়। "বাচ্চা মেয়েরা একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে, তা বলে তাঁর লাইসেন্স সিজ করবে পুলিশ?" মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে এ কি অনাচার। তবে দিদিমণির এই বক্তব্যটি শুনলে হয়তো বেজায় খুশি হবেন সলমন খান। তাঁরও তো ওই হিট অ্যান্ড রান গেঁড়ো আর কী।[ মেয়রের ভাইঝিকে 'বাচ্চা মেয়ে' বলে সার্টিফিকেট মুখ্যমন্ত্রীর]
তা এই বাচ্চা মেয়েটির কী দোষ ছিল যে ট্রাফিক পুলিশের মতে?
আসলে ২৪ বছরের 'বাচ্চা মেয়ে' দেবপ্রিয়া একটি ন্যানো গাড়ি চালাচ্ছিলেন, ট্রাফিক নীতি না মেনেই গাড়ি চালাচ্ছিলেন। একজন পথচারীকে গাড়ি দিয়ে ধাক্কাও মারেন। আর সবশেষে 'ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীন' হওয়ার হুমকিও দেন পুলিশকে। এমনকী তাঁর চাকরিও যেতে পারে বলে শাঁসান।
এর বাইরে আর একটা বিষয় ছিল, মানে ওই আর কী গাড়ি চালানোর সময় মদ্যপ ছিলেন অভিযুক্ত 'ছোট্ট মেয়ে'। এরপর আবার পাল্টা ওই ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে হেনস্থা করার অভিযোগও দায়ের করেছেন তিনি।
'বাচ্চা মেয়ে' ও 'ছোট ছেলেরা' ক্রমশই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ভারতের জন্য
২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন কলেজে কলেজে অধ্যক্ষ-অধ্যাপকদের হেনস্থা এমনকী মারধরেরও অভিযোগ আসছিল তৃণমূল ছাত্র পরিষদের বিরুদ্ধে। তখনও সেই ছাত্রদের 'ছোট্ট ছেলে' বলে আগলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ভাঙড় কলেজের ঘটনায় বলেছিলেন, 'দুষ্টুমি করাটা দামাল ছেলেদের একটা ধর্ম।'
আসলে 'ছোট্ট ছেলে', 'বাচ্চা মেয়েরা' একটু 'দুষ্টুমি' করলেই মিডিয়া রে রে করে তেড়ে যায় দোষটা তো মিডিয়ারই। কিন্তু দুষ্টুমিতে শাসন না করে বারে বারে আসকারা দিলে বাচ্চারা যে বাঁদর তৈরি হয় তা হয়তো জানা নেই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর। বাচ্চাদের বাঁদর করার পাশাপাশি রাজ্যটাকেও যে তিনি মগ ডাল বানিয়ে ফেলছেন তারও হুঁশ নেই।
সৎভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের জন্য যদি পুলিশকে যদি মুখ্যমন্ত্রী বা অন্যান্য ক্ষমতাশালী নেতাদের জবাবদিহি করতে হয় তাহলে তো রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গুর হয়ে পড়তে পারে। (পড়তে পারে বলাটা হয়তো এখানে ভুল হল।)
নিজের বেলায় বাচ্চা মেয়ে, ছোট্ট ছেলে? পরের বেলায় খুনের মামলা
একদিকে মদ্যপ অবস্থায় হিট অ্যান্ড রান মামলাকে বাচ্চা মেয়েদের একটা ঘটনা বলেই খালাস মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ এখানে অভিযুক্ত আদরের শোভেনের ভাইঝি। অন্যদিকে পরিস্থিতিতে তিতিবিরক্ত হয়ে মঞ্চে উঠে মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যাকে শুধু একটি চড় মারায় খুনের মামলা দায়ের করা হয়েছিল তরুণ দেবাশিস আচার্যর বিরুদ্ধে। [অভিষেককে চড় মারায় খুনের চেষ্টার মামলা দেবাশিস আচার্যর বিরুদ্ধে!]
তার উপর তৃণমূল কর্মীদের যে গণপিটুনি খেয়েছিল সে তা তো আলাদা। কিন্তু কই তখন তো একবারও ছোট ছেলেমেয়েদের মসিহা হয়ে চাওয়া মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর মনে হয়নি, বাচ্চা ছেলেটা ভুল করে ফেলেছে, বা একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। না হয়নি, কারণ অভিযুক্তর উল্টোদিকে তখন ছিলেন তাঁর নিজের ভাইপো। এহেন দ্বিচারিতা মুখ্যমন্ত্রী!
মমতার 'বাচ্চা মেয়ে' বনাম মুলায়মের 'তরুণ ছেলেরা'
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাচ্চা মেয়ে তত্ত্ব মনে করিয়ে দেয় আর এক হেভিওয়েট নেতা সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদবের ছেলেরা তো ছেলেই তত্ত্ব। ধর্ষণ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, "লড়কে লড়কে হোতে হ্যায়, গলতি হো যাতি হ্যায় (ছেলেরা ছেলেই হয়, ভুল করে ফেলে।)" [ছেলেরা ভুল করে ধর্ষণ করে, তার জন্য ফাঁসি দেওয়া উচিত না : মুলায়ম সিং যাদব]
এমনকী ধর্ষণের জন্য কাউকে ফাঁসি দেওয়া উচিত না বলেও ধারণা মুলায়মের। তিনি বলেছিলেন, ধর্ষণের জন্য ফাঁসি দেওয়া উচিত নয়। ছেলেরা ভুল করে ফেলে। আমরা ক্ষমতায় এলে আইনে বদল আনব।
কাউন্সিলিং প্রয়োজন ঠিকই কিন্তু কার?
দেবপ্রিয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে নাম না করে 'অভিযুক্ত' ট্রাফিক পুলিশের উদ্দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায় এও বলেন, "সবার কাউন্সিলিং দরকার।"
মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন ছিল "বাচ্চা মেয়েদের একটা ঘটনা ঘটেছে, তা বলে পুলিশ কেন লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করবে?" তাহলে ট্রাফিক আইন ভেঙে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে এক পথচারিকে ধাক্কা দিলে ট্রাফিক পুলিশের কী করণীয় যদি মুখ্যমন্ত্রী একটু বলে দেন।
হ্যাঁ এটা ঠিক যে ওই দুর্ঘটনায় কেউ গুরুতর আহত হননি। কিন্তু প্রশ্নটা এখানে দুর্ঘটনার নয়, প্রশ্নটা মনোভাবের, যেটা অবশ্যই শিগগিরই বদলানো দরকার। আইন কারও জন্যই আলাদা হওয়া উচিত নয়। বরং মুখ্যমন্ত্রীর নিজেরই উচিত আইনের উর্ধে কেউ নয় সেই বার্তা দেওয়া। তা না করে দেশের নেতা মন্ত্রীরা নিজেদের 'বাচ্চা মেয়ে' 'ছোট্ট ছেলেদের' দুষ্টুমিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে।