ভঙ্গুর সিঙ্গুর: প্রথমে ভাঙা হল মানুষের বিশ্বাস, আর এখন কারখানার শেড
শুরু হতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। ভাঙা শুরু হতে বেশিদিন লাগল না। শীর্ষ আদালতের রায় আসার প্রায় সপ্তাহ তিনেক পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সিঙ্গুরের বিতর্কিত ও পরিত্যক্ত ন্যানো গাড়ি কারখানার শেড ভাঙার কাজ শুরু করে দিল। প্রায় এক দশক আগে অনেক জলঘোলার পর এই কারখানার কাজ শুরু হয়েছিল। সোমবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, সিঙ্গুর বৃত্তান্তের ষোলোকলা পূর্ণ হল।
এই ভাঙার চিত্রটি বেশ প্রতীকী। বাঙালি গড়তে যতটা না পারদর্শী, তার চেয়ে অনেক বেশি ভাঙতে। সিঙ্গুরে প্রথমে ভাঙা হল মানুষের ভরসা, তারপর কৃষির কোমর, এখন শিল্পের ভিত্তি এবং সবমিলিয়ে রাজ্যের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথ। কিন্তু তাতে রাজ্যের শাসককূলের কী? বাম বা ডান, গ্যালারি শো দিতে তাঁরা এতটাই ব্যস্ত যে রাজ্যের টাইম মেশিনে চড়ার এমন মোক্ষম দৃশ্য, আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে বসে, চাক্ষুষ করতে বেশ অদ্ভুতই লাগছে। শিল্প ভেঙে আমরা এখন চলেছি কৃষির পানে। কী মজা!
অথচ এই ন্যানো ফ্যাক্টরিই পশ্চিমবঙ্গের ঝিমিয়ে পড়া শিল্প ক্ষেত্রে উন্নতির আনতে পারত। হল না, স্রেফ রাজ্যের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃত্ববর্গের অপদার্থতার জন্য।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের না ভেবেচিন্তে কাজ রাজ্যের ভবিষ্যতের বারোটা বাজিয়েছে
একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের মধ্যভাগে দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জিতে বুদ্ধদেবের ক্ষমতান্ধ সরকার যখন গা-জোয়ারি শিল্পায়ন করতে গেল, তখনই বাংলার অর্থনীতির আকাশে ঘনিয়ে এসেছিল কালো মেঘ। যে রাজ্যে তার আগের প্রায় দিন দশকে শিল্প বলতে অর্থে বোঝা যেত স্রেফ রাজনৈতিক পেশিশক্তির আস্ফালন, সেখানে রাতারাতি গুজরাতি বা দেশের অন্যান্য শিল্পোন্নত রাজ্যগুলি কায়দায় নিমেষে "কেমন শিল্প করে দিলুম" দেখাতে গিয়ে বুদ্ধদেব সরকার সেই যে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, আর উঠতে পারলেন না।
বুদ্ধদেব গর্বাচেভ? হাসালেন
অনেকেই দেখি বুদ্ধদেবকে সিঙ্গুরে কারখানা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে 'পশ্চিমবঙ্গের গর্বাচেভ' বলে ডাকে, বুঝি না সেটা প্রকৃত প্রশংসা না স্রেফ মস্করা, কিন্তু প্রবল আত্মবিশ্বাসী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আদতে চীনদেশের কমিউনিস্ট শাসকদের মতো 'জবরদস্তি স্টাইল'-এ দ্রুত খ্যাতি অর্জন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারত যে চীন নয়, সেটা বোঝেননি।
ইতিহাস গড়তে গিয়ে পড়লেন ইতিহাসের গর্তে
বুদ্ধদেব আর তাঁর সভাসদরা যদি সত্যিই বঙ্গের শিল্পভাগ্য ফেরাতে চাইতেন, তাহলে তার জন্যে মাটির কাছাকাছি থেকে আরও সময় দিতেন প্রকল্পটি রূপায়ণে যাতে করে এটির মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ এর নতুন দিশা খুঁজে পায়। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রকল্পটির সামাজিক মূল্য কী হতে পারে, সেসব যাচাই না করে সর্বহারাদের দলের ভদ্রলোক-নেতৃত্ব ঝাঁপিয়ে পড়লেন ইতিহাস গড়তে কিন্তু আসলে গিয়ে পড়লেন ইতিহাসের গর্তে।
কারও সর্বনাশ তো কারও পৌষমাস
অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি তখন পরপর দু'টি রাজ্য নির্বাচন হেরে আর লোকসভাতেও তাঁর দল, তৃণমূল কংগ্রেসের একমাত্র সাংসদ হিসেবে খুব একটা ভালো জায়গায় নেই, পেয়ে গেলেন একটি মোক্ষম সুযোগ। জোর করে কৃষকের জমি নিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে রোমান্টিক বাঙালির একটি স্বাভাবিক আক্রোশ তো জন্মালই, তার সঙ্গে যোগ হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চাল-কৌশল।
এর মধ্যে তাপসী মালিকের ধর্ষণ ও খুন আগুনে আরও ঘৃতাহুতি দিল এবং বুদ্ধদেব সরকারের নৈতিক পতনের সূচনা হল। ২০০৭-এর মার্চে বাম সরকারের একইরকম আরেকটি অর্থনৈতিক প্রকল্প পরিকল্পনা ব্যর্থ হল নন্দীগ্রামে এবং পুলিশের গুলিতে মারা গেলেন বেশ কিছু কৃষক। এরপর ২০০৮ সালে টাটা গোষ্ঠী সিঙ্গুর ত্যাগ করল এবং তার পরের তিন বছর চলল বামফ্রন্টের চূড়ান্ত অবক্ষয় । ২০০৯ এবং ২০১০-এ যথাক্রমে দেহত্যাগ করলেন সুভাষ চক্রবর্তী এবং জ্যোতি বসু এবং ২০১১ তে বাংলায় শেষ হল ৩৪ বছরের বাম শাসন।
যে দলটি একসময় ভূমিসংস্কারের মধ্যে দিয়ে মানুষের মন জয় করে আমদানি করেছিল গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়নের নতুন সমীকরণ, তারাই যে তিন দশক পরে সেই মানুষেরই জমি কেড়ে নেবে বাজার-অর্থনীতির পায়ে পা মেলাতে গিয়ে, তা অনেকের কাছেই অভাবনীয় ঠেকেছিল। কিন্তু সময়ের চাহিদা অনুযায়ী এই রূপান্তর প্রয়োজনীয় হলেও বুদ্ধদেবের সরকার যে হঠকারিতার মাধ্যমে এই বদল আনতে চেয়েছিল, সেটা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়।
'সিঙ্গুরে মেঘ' দেখবে এবার থেকে সব সরকারই
এই ভুলের মাশুল শুধু বামফ্রন্ট দেয়নি, দিয়েছে পুরো রাজ্যই। সেদিন যেই মমতা এই সিঙ্গুরে জাতীয় সড়ক আটকে হত্যে দিয়ে বসে পড়েছিলেন টাটাদের তাড়ানোর জন্যে, তিনি আজ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মধ্যে দিয়ে ফের প্রমান করলেন যে তাঁর শিল্প-বিরোধিতার পথটিই ঠিক ছিল। আবার, এতে শক্ত হল শিল্প গড়তে তাঁর ল্যান্ড-ব্যাঙ্কের তত্ত্বও কারণ জনপ্রিয়তাবাদের কারণে মমতা আর যাই হোক, কোনো জমির গায়ে হাত দেওয়ার কথা ভুলেও মুখে আনবেন না।
বা বলা চলে, ভবিষ্যতের বাংলার আর কোনও সরকারই তা আনবে না ভোট হারাবার ভয়ে। মাঝেমাঝে কলাটা-মুলোটা আলোচনা হবে ঠিকই, কিন্তু যতটা সহজে সিঙ্গুরে আজ শেড ভাঙা হচ্ছে, ততটা সহজে আর কোথাও বড় আকারের শেড লাগানো হবে কিনা, সেব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। কারণ, ওই সিঙ্গুরে মেঘ।
মমতা শীর্ষ আদালতের দ্বারে ফের একটি ঐতিহাসিক জয় পেলেন ঠিকই, কিন্তু আদতে রাজ্যের কতটা উপকার হল? আর সিঙ্গুরের ওই কংক্রিট মেশানো জমিতে এখন কিসের চাষ হবে? ফ্ল্যাটবাড়ির কি?
আসল কথা, ওই যে বললাম, বাঙালি ভাঙার কাজটা খুব ভালো পারে। কারখানার শেডটা ভেঙে ফেললেই কাম তামাম। আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাস বহাল তবিয়তেই থাকবে।