মমতা বলছেন 'বিজেপি ভারত ছাড়ো', তাহলে কোথায় যাবেন বাজপেয়ী-আডবাণী-মোদীরা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 'বিজেপি ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। কিন্তু, বাস্তবে আদৌ কি এটা হওয়া সম্ভব। ক্ষমতা থেকে বিজেপি-র সরে যাওয়ার সঙ্গে 'বিজেপি ভারত ছাড়ো'-র কি আদৌ কোনও মিল আছে?
২১ জুলাই-এর সমাবেশ মঞ্চ থেকে নতুন করে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক উঠেছে। আর এই ডাক দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 'ভারত ছাড়ো' শব্দটা শুধু বাঙালিদের সঙ্গে নয় সমস্ত ভারতবাসীর আত্মার সঙ্গে মিশে রয়েছে। বিশেষ করে যাঁরা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত তাঁদেরকে 'ভারত ছাড়ো' ডাকের মর্মার্থ বোঝানোর খুব একটা দরকার নেই। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণশক্তিকে সজাগ করতে বলে রাখা ভাল ১৯৪২ সালে 'ইংরেজ ভারত ছাড়ো'-র ডাক দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
সমগ্র দেশবাসীর উদ্দেশে মহাত্মার সেই ডাকের পর কেটে গিয়েছে অর্ধ শতকেরও বেশি সময়। কিন্তু, ২০১৭-র ২১ জুলাই কলকাতার বুকে মহাত্মার আন্দোলনেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলাতে। মহাত্মা 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। আর মুখ্যমমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনের কর্মসূচির নিশানায় রয়েছে বিজেপি।
[আরও পড়ুন:মহাত্মার 'ভারত ছাড়ো'-র সঙ্গে আদৌ কি মিল আছে মমতার আন্দোলনের]
হিন্দুত্ববাদকে নীতি করে যে রাজনৈতিক পরিচয়ে বিজেপি পার্টির জন্ম হয়েছিল তার পুরোধাদের কেউই এখন বেঁচে নেই। যাঁরা আছেন তাঁরা বলা যেতে পারে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়দের উত্তরসূরি। তাও এঁদের মধ্যে অনেকেরই বয়স আশি পেরিয়ে গিয়েছে।
[আরও পড়ুন:২১শের মঞ্চেও নারদের ছায়া, পাল্টা হুঁশিয়ারি তৃণমূল সুপ্রিমোর ]
যেমন অটল বিহারী বাজপেয়ী। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া বিজেপি-র এই নেতা এখন হাঁটুর ব্যাথায় এক্কেবারে প্রায় শয্যাশায়ী অবস্থা। বয়স এখন তাঁর ৯২ বছর। বাড়ি থেকে বের হওয়া তো দূরের কথা নিজের ঘরের বাইরে আসতেও বাজপেয়ীকে কারোর সাহায্য নিতে হয়। বাজপেয়ী 'ডিমেনশিয়া'-তেও ভুগছেন। সহজে কিছু মনেও করতে পারেন না। সুতরাং 'বিজেপি ভারত ছাড়ো'-র যে ডাক উঠেছে তাতে তিনি এই বয়সে কোথায় যাবেন বলা শক্ত। আর সবচেয়ে বড় কথা তিনি ভারতীয় নাগরিক। তৃণমূলের 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলন কার্যকর হলে তিনি এই বয়সে আতঙ্কিত হতেই পারেন।
[আরও পড়ুন:মোদীকে 'বড়দা' বলে সম্বোধন মমতার, কিন্তু 'বোনের' বচন যেন ছুরির ফলা ]
বিজেপি-র আরএক শীর্ষনেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী। রাজনীতিতে বাজপেয়ীর-ই সমসাময়িক। বয়সে বাজপেয়ীর থেকে তিন বছরের ছোট আডবাণী। তাঁর বর্তমান বয়স ৮৯। এখনও লোকসভার সাংসদ তিনি। কিন্তু, শারীরিকভাবে খুব যে তিনি সুস্থ তেমনটা বলা যায় না। বয়স হলেও স্মৃতিশক্তি প্রখর। বিজেপি-র শীর্ষনেতৃত্বের একটা অংশে এখনও প্রবল প্রভাবশালী নেতা তিনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মোদীর সমালোচনা করতেও ছাড়েননি আডবাণী। এহেন আডবাণীর জন্ম পাকিস্তানে। কিন্তু, ভারত ছাড়া তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অন্যকিছু প্রাধান্য পেয়েছে এমনটা কেউ বলার সাহস দেখাবে না। সুতরাং, দেশপ্রেমিক আডবাণীকে এই বয়সে 'ভারত ছাড়া' করলে যাবেন কোথায়?
রাজনাথ সিং। বাজপেয়ী, আডবাণীদের জামানারই জুনিয়ার। বর্তমানে বিজেপি-র অন্যতম শীর্ষনেতা। মোদী সরকারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তিনি। সম্প্রতি পায়ে চোট পেয়ে প্লাস্টার বেঁধে বেশকিছুদিন বাড়িতেই কাটাতেই হয়েছিল রাজনাথকে। বাজপেয়ী, আডবাণীদের মতো বয়স না হলেও তিনি যে এক্কেবারে তরুণ এটা কোনওভাবেই বলা যাবে না। তারপরে রাজনাথ সিং উত্তরপ্রদেশের খাস লোক। সুতরাং, তৃণমূল যেভাবে 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে নেমে বিজেপি খেদাও অভিযান করতে চাইছে তাতে রাজনাথ চিন্তায় পড়তেই পারেন। জন্ম থেকে এই ভারতকেই নিজের মাতৃভূমি হিসাবে জানেন তিনি। তাহলে দেশ ছাড়া হলে যাবেন কোথায়?
মোদী সরকারের আরএক জনপ্রিয় সদস্য সুষমা স্বরাজ। রাজনীতিতে তিনিও রাজনাথদের সমসাময়িক। নরেন্দ্র মোদীরও আগে রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন। বাজপেয়ী, আডবাণীদের জুনিয়র ব্রিগেডের সদস্য তিনি। বিদেশে আটকে থাকা ভারতীয়দের দেশে ফেরাতে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ-এর দরাজ উদ্যোগে এখন তো গল্পগাথায় পরিণত হয়েছে। সৌদি আরব হোক বা ইরাক, কাতার- যেখানেই যখন ভারতীয়দের আটকে পড়ার খবর তাঁর কানে এসেছে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সুষমা। এমনকী, উত্তর ২৪ পরগনারই এক যুবককে সৌদি আরব থেকে উদ্ধার করে এনেছিলেন। কলকাতার মেয়ে জুডিথ অপহৃত হয়েছিলেন কাবুলে। তাঁকেও কলকাতায় মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে এনেছেন সুষমা। এহেন সুষমা এখন বলতেই পারেন তৃণমূল যদি বলে 'ভারত ছাড়ো' তাহলে যাব কোথায়? সত্যিকারে এক ঘোর সঙ্কট সুষমার কাছে। দেশের মানুষকে যিনি দেশে ফিরিয়ে আনছেন তাঁকেই কিনা উৎখাত হতে পারে দেশ-মাটি থেকে!
কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও সদস্য বা সাংসদও নন অমিত শাহ। তিনি বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি। বলতে গেলে এই মুহূর্তে দেশের শাসক দলের অন্যতম দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি। এহেন অমিত শাহ গত বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে এসে বহু কথাই বলেছিলেন। মমতা এবং তাঁর সরকারকে উৎখাতের কথাও বলেছেন। তৃণমূলনেত্রীও ছাড়েননি। কিন্তু, অমিত শাহ ভারতীয় নন এমন অভিযোগ আজ পর্যন্ত কেউ করেছেন কি না জানা নেই। তৃণমূলের 'বিজেপি ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে কি তিনি চিন্তায়? এই মুহূর্তে বিজেপি দলের সরকারিভাবে অমিত এক নম্বর নেতা। বাক্স-প্যাটারা নিয়ে তাহলে কোথায় যাবেন অমিত শাহ? ২১ জুলাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুমকির পর কি কিছু ঠিক করলেন?
এই মুহূর্তে দেশের একনম্বর 'ব্র্যান্ড' তিনি। নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে তাই বেশিকিছু বলার নেই। তবে, এটা অনেকেই হয়তো জানেন, জীবনের একটা সময় সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন মোদী। বেলুড় মঠেও এসেছিলেন সন্ন্যাসী হতে। ভেবেছিলেন সন্ন্যাসী জীবনে এই ধরাধামের কোথাও একটা কাটিয়ে দেবেন। সেটা দেশ হোক বা পরদেশ তা নিয়ে খুব একটা চিন্তা মোদী করেছিলেন বলে জানা যায় না। কিন্তু, এখন ছবিটা একদমই উল্টো। মোদী দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন বলেই দাবি করেন। নিজেকে কট্টর ভারতীয় বলতেই পছন্দ করেন তিনি। ভারতীয় সংস্কার, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিতে বিশ্বের দরবারে তিনি তুলে ধরতে উদ্যোগী বলেই দাবি করেন। তাই মমতার 'বিজেপি ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে মোদী কী করতে পারেন? সেটাই এখন প্রশ্ন। বিদেশে বহু যাতায়াত করেন বলে মোদীর নাম আছে। তাই বলে নিজ দেশ ছাড়তে কি রাজি হবেন মোদী? নাগরিকত্বের ভিত্তিতে তাঁকে তো দেশছাড়া করাটা কঠিন!
তাহলে, প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে 'বিজেপি ভারত ছাড়ো' বলে যে আন্দোলনের ডাক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছেন তা কি আসলে রূপকার্থে ব্যহৃত হয়েছে? উত্তরটা কি মিলবে?