১০২ তম জন্মদিন জ্যোতি বসুর : মমতাকে সামলে দলকে বাঁচাতে তাঁকেই আজ প্রয়োজন বামেদের
জ্যোতি বসু। বাংলার রাজনীতিতে নানা কারণে এই নামটি চিরকাল অক্ষয় হয়ে থাকবে। একটি প্রদেশের নেতা হয়েও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল দেশব্যাপী। রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে তাঁর ছিল আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। নিজের কর্তৃত্বে ও দক্ষতায় তিনি বাংলা শাসন করেছেন দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে।
এদিন ৮ জুলাই, জ্যোতি বসুর ১০২তম জন্মবার্ষিকী। তিনি এমন এক নেতা ছিলেন যিনি শত বিতর্ক সত্ত্বেও দলের পতন রোধ করেছিলেন। আর আজ তাঁর মৃত্যুর ছয় বছর পরে গভীর সঙ্কটে বামপন্থী আদর্শ। তিনি ভাগ্যিস বেঁচে নেই। নাহলে দলের এবং আদর্শের এমন দশা দেখে কী করতেন ঈশ্বরই জানেন।
জীবদ্দশায় পশ্চিমবঙ্গে বামদুর্গের পতন দেখে যেত হয়নি জ্যোতিবাবুকে। ২০১০ সালে তিনি গত হয়েছেন। তবে সেই আশঙ্কা শেষজীবনে তাঁর সঙ্গী হয়েছে অবশ্যই। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে হারার আগে ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ও পরে ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পরপর হার হয় বামপন্থীদের। জ্যোতি বসু তখন শয্যাশায়ী। তখন তাঁর বিপর্যয় দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না।
আর আজ তাঁর মৃত্যুর কয়েকবছরের মধ্যেই কার্যত উঠে যেতে বসেছে বামপন্থী আদর্শ। সিপিএম সহ বামপন্থী দলগুলি এরাজ্যে সাইনবোর্ডে পরিণত হয়েছে। চিরশত্রু কংগ্রেসের সঙ্গে নীতি-আদর্শ বিকিয়ে 'আসন সমঝোতা' (জোট বলাটাই ঠিক) করতে হয়েছে তৃণমূল সরকারকে উৎখাত করার জন্য।
তবে সেই ভাবনাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে বাংলার জনতা। মাঝখান থেকে 'নেপোয় মারে দই' প্রবাদটি সত্য করে বামেদের পিছনে ফেলে এখন রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের তকমা পেয়েছে কংগ্রেসই। আর বামপন্থীরা সেই কবে ঘি দিয়ে ভাত খেয়েছেন, সেই গন্ধ শুঁকে ইতিহাস হাতড়ে চলেছেন।
জ্যোতি বসুর অনুপস্থিতিতে ছন্নছাড়া বামপন্থা
এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল? যে নীতি আদর্শ নিয়ে বামপন্থীরা গর্ব করত একসময়ে, সেই ঐতিহ্য, সেই শ্লাঘাবোধ কোথায় হারিয়ে গেল? একজন মানুষের না থাকা এতটা পার্থক্য গড়ে দেবে? এমন জিনিস তো 'এক নেতা-ওয়ালা' দলে সম্ভব, তথাকথিত 'রেজিমেন্টেড' বামপন্থী দলে এটাও সম্ভব?
ডানপন্থীরা বহুদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছে এই বলে যে, বামপন্থার আদর্শ আজকের যুগে দাঁড়িয়ে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। বাংলার বামপন্থী নেতারা অন্তত এই কথাটি সত্য করে দেখিয়েছেন। নেতৃত্বহীন বাংলার সিপিএম তথা বামেরা আজ দিশাহীনতায় ভুগছে। এরাজ্যে যুযুধান কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করছে তো কেরলে সেই কংগ্রেসকে হারিয়েই ক্ষমতায় ফিরছে বামপন্থীরা।
বামপন্থা গতি ও পথ দুই-ই হারিয়েছে। বাংলাকে দিশা দেখানোর বদলে নিজেরাই দিশাহীন হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় কেউ যদি দলকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলতে পারতেন তা একমাত্র জ্যোতি বসু। ১৯৬৪ সালে দল ভাগাভাগির পরেও নিজের লক্ষ্যে যেমন অবিচল ছিলেন জ্যোতি বসু। কয়েকবছরের মধ্যেই ক্ষমতার ফিরে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। তেমনভাবেই এই মুহূর্তে দলকে বাঁচিয়ে তুলতে গেলে তাঁরই প্রয়োজন ছিল।
জ্যোতি বসুর পরের প্রজন্মে সেই মাপের কোনও নেতা আর উঠে আসেননি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দলের পতন রোধ করতে পারেননি। এখন তিনি অসুস্থ। মিটিং-মিছিল করতে পারেন না। দলের প্রয়োজনে একটি রোড শো করা ছাড়া গত নির্বাচনে তাঁকে দেখা যায়নি।
গত কয়েকবছরে সিপিএম তথা বামেদের প্রধান মুখ সূর্যকান্ত মিশ্রর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দলের মধ্যেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এই বিধানসভা নির্বাচনে জোটের অন্যতম কাণ্ডারী তিনি। নিজের পছন্দের কেন্দ্র নারায়ণগড় থেকে লড়েও তিনি পরাজিত হয়েছেন।
আদর্শ নাকি বাস্তবতা, কোনটা আগে এটা নিয়ে ধন্দ বামপন্থীদের
নীতি-আদর্শ আর বাস্তব বোধের মধ্যে বারবারই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে বামপন্থী নেতাদের মননে। জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী না হওয়া থেকে শুরু হয়ে তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে অসামরিক পরমাণু চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারের হাত ছেড়ে বেরিয়ে আসার মধ্য দিয়ে। আর এইসবের মাঝে পড়ে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষেই বামপন্থার আদর্শ জৌলুস হারিয়েছে।
বারবারই অভিযোগ উঠেছে, নীতি আঁকড়ে থাকতে গিয়ে বাস্তবতাকে গুরুত্ব দেননি বামপন্থীরা। আর সেজন্য মধ্যবিত্ত সমাজ বুদ্ধবাবুদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর তার সুযোগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা নরেন্দ্র মোদীর মতো ব্যক্তিদের হাত ধরে থাবা বসেছে বাম ভোটব্যাঙ্কে।
এর পাশাপাশি অবশ্যই রয়েছে নেতৃত্বহীনতা। জ্যোতিবাবুর পর সেজন্যই বাম কোনও নেতাকে উঠে আসতে দেখা যায়নি। ধীরে ধীরে জ্য়োতিবাবুর পথ অনুসরণ করে বাংলার নেতৃত্ব হাতে নিয়ে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
জ্যোতি বসু হয়ত মমতার মতো আমজনতার মাঝে মিশে যেতেন না। তবে তাঁর ব্যক্তিত্ব এমন আকাশচুম্বী ছিল যে মানুষ এমনিতেই তাঁকে জননেতা হিসাবে মেনে নিয়েছিল। পরে সেই মাপের কোনও নেতা আসেননি। আবার বামেরাও মানুষের মাঝে মিশে যেতে পারেননি। আর এই করতে করতে জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে গোটা দলটি।
নতুন নেতার অভাব
জ্যোতি বসু বাম নেতৃত্বের মুখ হলেও তাঁকে পিছন থেকে নির্ভরতা দেওয়ার জন্য অনেক বড় বড় নাম ছিল সেসময়ে। অনিল বিশ্বাস, সুভাষ চক্রবর্তী, বিনয় চৌধুরী, শৈলেন দাশগুপ্ত, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুর মতো দক্ষ নেতা ও সংগঠন জ্যোতি বসুকে ঘিরে রেখেছিলেন। তবে এরা ধীরে ধীরে বিদায় নেওয়ার পরে দলে ভালো নেতার শূন্যস্থান তৈরি হয়। যা পরে আর কখনও পূরণ করা যায়নি। আর সেজন্যই যত দিন গিয়েছে, অতল খাদে তলে গিয়েছে বামেরা।
নেতা হিসাবে জ্যোতি বসু
দীর্ঘ ২৩ বছর রাজ্য শাসন করেছেন জ্যোতি বসু। তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে ভালো-খারাপ দুটোরই সাক্ষী থেকেছে জনতা। ভারী শিল্প ক্ষেত্রে যেমন ধীরে ধীরে শূন্যতা তৈরি হয়েছে । প্রতিটি ক্ষেত্রে তেমন রাজনীতির শেকড় গজিয়ে উঠেছে। ইংরেজি ও কম্পিউটার শিক্ষাকে সাদরে গ্রহণ না করে বাংলাকে অনেকটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হাহাকার পড়েছে।
অন্যদিকে, ভূমি সংষ্কারের মতো কর্মসূচী ও কৃষিক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ করে রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন জ্যোতি বসু। এর পাশাপাশি আশি ও নব্বইয়ের দশকে যখন দেশের নানা প্রান্তে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পড়েছে, তখন বাংলার গায়ে একটাও আঁচ লাগতে দেননি জ্যোতি বসু তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে।
মানুষ হিসাবে জ্যোতি বসুর ইমেজ
জ্যোতি বসুর নেতৃত্ব থাকা বাম জমানায় সমাজবিরোধী কার্যকলাপ ছিল না এমনটা অতি বড় বাম সমর্থকও বলবেন না। তবে এযুগে যেভাবে দল নির্বিশেষে নেতা-নেত্রীরা ব্যক্তিগত আক্রমণ ও কাদা ছোঁড়াছুড়িতে নেমে আসেন, সেখানে রাজ্যের ভদ্রলোক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করতেন একমাত্র জ্যোতি বসু। আর তাও দলমত নির্বিশেষে। সেই বোধের বড় অভাব আজকের রাজনীতিতে।
দলের কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন জ্যোতি বসু
সমালোচকরা বলেন, ক্ষমতায় আসার দশ বছরের মধ্যেই ফিরে হতে শুরু করেছিল বাম আদর্শ। তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল খাওয়া-দাওয়ার পালা। ক্ষমতায় থাকার ফায়দা তুলে রাজ্য়ের মানুষকে শোষণ করেছে সিপিএম তথা বামপন্থীরা। আর তখন থেকেই বামপন্থার অধঃগমন শুরু।
কথাটা যে খুব ভুল তা নয়। বিভিন্ন সময়ে বামপন্থী নেতাদের কথাতেও এই ভাব ফুটে উঠেছে। অনেকে দল ছেড়ে চলে গিয়ে সরাসরি বিদ্রোহ করেছেন, কাউকে বহিঃষ্কার করা হয়েছে। তবে জ্যোতি বসু যিনি নেতা ও সংগঠন হিসাবে দলরকে আত্মশুদ্ধির পথ বাতলে দিতে পারতেন, সেই পথে কখনও যাননি। তা সত্ত্বেও আজকের যুগে দাঁড়িয়ে বাংলার মাটিতে কেউ যদি মমতা-মোদী স্রোতকে আটকাতে পারতেন তা ওই জ্যোতি বসু-ই, আর কেউ নন।