উদারবাদী দুনিয়ার শেষ ভরসা এখন জার্মান চ্যান্সেলার আঙ্গেলা মের্কেল?
ব্রেক্সিট, ওবামার বিদায় এবং হিলারির পরাজয়, ফ্রান্সে অতি-ডানপন্থী রাজনীতির উত্থান -- এসবের মাঝে এখন মের্কেলকেই শেষ উদারবাদী নেত্রী হিসেবে মানছেন বিশেষজ্ঞরা
ইতিহাসের পরিহাস বোধহয় একেই বলে। ব্রিটেনের ব্রেক্সিট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় এবং সন্ত্রাসবাদী আঘাতে দীর্ণ ফ্রান্সে অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থানের পর এখন জার্মানিকেই উদার দুনিয়ার শেষ স্টেশন বলে ধরা হচ্ছে। একদা যে জার্মানিতে আডল্ফ হিটলারের কুখ্যাত নাৎজি বাহিনী নানা অত্যাচার করে বেরিয়েছে, সেই জার্মানিকেই এখন উদার বিশ্বের নেতৃত্বে দেখে অনেকেরই মনে হতে পারে: ইতিহাসের পরিহাস।
কিন্তু আমেরিকার মাটিতে রক্ষণশীল শক্তির বিকাশ এবং ইউরোপের অন্যান্য প্রান্তে অতি-ডানপন্থীদের বিকাশ আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের যেমন ভাবাচ্ছে, তেমনি তাঁদের সামনে এই বার্তাও রাখছে যে উদারবাদীদের শেষ আশা এখন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেলই।
২০০৫ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকা বছর বয়সী মার্কেল আজ শুধু বিশ্বের কতিপয় মহিলা নেত্রীর একজন তাই নয়, তিনি জার্মানিকে স্থিতিশীলতা দেওয়া ছাড়াও বিশ্ব রাজনীতিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এক রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন ছাড়া আর কোনও দেশের নেতা বা নেত্রী এতদিন টিকে থাকেননি একটানা। আর পুতিনের থেকে মের্কেলের স্থায়িত্বের গুরুত্ব নিঃসন্দেহে বেশি কারণ তিনি একটি গণতান্ত্রিক দেশের নেত্রী। গণতান্ত্রিক অর্থে দুর্বল রাশিয়াতে প্রভাবশালী পুতিনের শীর্ষে বসে থাকা সেখানে অনেকটাই সহজ।
মের্কেলের একটি বড় গুণ হচ্ছে যে তাঁর মেয়াদকালে বিভিন্ন রাষ্ট্রের নেতৃত্বে বদল ঘটলেও পেশায় চিকিৎসক মার্কেল কিন্তু তাদের সবার সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রেখেছেন। আদর্শগত তফাৎও তাঁর বিদেশনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেনি। অতীতে মার্কিন বা ইতালিয়ান রাষ্ট্রপতিদের সঙ্গে মের্কেলের রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত বিতর্ক হলেও মের্কেল তার প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলির উপরে পড়তে দেননি। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার বিরুদ্ধে একবার অভিযোগ উঠেছিল যে তিনি মের্কেলের উপর নজরদারি চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিতর্ক বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।
আর তাই ঠান্ডা মাথার মের্কেলের সমর্থনে আজ অনেকেই বলছেন যে বিশ্বের অনেক বড় শক্তিই যেমন আজ কট্টরপন্থার দিকে ঝুঁকেছে, সেখানে জার্মান চ্যান্সেলরের কাঁধে একটি ভারসাম্য বজায় রাখার দায়িত্ব এসে পড়েছে। তিনি যদি এই কাজটা সফলভাবে করতে পারেন, তাহলে অনেক বড় সমস্যার ক্ষেত্রেই সমাধান পেতে সহজ হবে।
আর বর্তমান পরিস্থিতিতে যে মের্কেলও জার্মানিকে বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্বের সামনের সারিতে নিয়ে যেতে চান তার আঁচও পাওয়া যায় সম্প্রতি ট্রাম্প মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেতার পরে। মের্কেল বলেন উদারবাদের প্রতি আনুগত্যই ওয়াশিংটনের সঙ্গে বার্লিনের সম্পর্কের অন্যতম প্রধান নির্ণায়ক। গত সোমবারও (নভেম্বর ১৪) মের্কেল জানান যে জার্মানি ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির সম্মান রক্ষা করতে ব্রতী। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মধ্যে বিতর্কিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট ট্রাম্পের প্রতি বার্তা পরিষ্কার।
এমনকি, বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ওবামা তাঁর অন্তিম বিদেশ সফরে বার্লিনে দাঁড়িয়ে যখন বলেন মের্কেল তাঁর সবথেকে কাছের মিত্রদের একজন, তখন বুঝতে হয় না যে লন্ডন বা প্যারিস নয়, ওবামা মের্কেলকেই অদূর ভবিষ্যতের উদার দুনিয়ার নেত্রী হিসেবে দেখছেন।
যদিও বিশ্ব শক্তি হিসেবে জার্মানি কখনওই আমেরিকার বিকল্প হতে পারে না এবং মের্কেল ঘরে এবং বাইরে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু তবুও তিনি যে একাই কট্টরপন্থী দুনিয়ার বিকল্প মুখ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন, তাই বা কম কী?