ভাব-ভালোবাসা পরে হবে, আগে বাংলাদেশের সীমানা আটকানোর কথা ভাবুন
এইসব কি আমাদের পোষায়? গত ২৪শে সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকায় বেরোনো একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে চলা মৈত্রী এক্সপ্রেস যখন কলকাতা স্টেশনে পৌঁছচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে যতজন যাত্রী হওয়া উচিত, আসল সংখ্যাটা তার চেয়ে বেশ কম। অর্থাৎ, অনেক লোক মাঝপথেই হারিয়ে যাচ্ছে। এবং তাদের মধ্যে রয়েছে বিদেশিও।
এরপর ২৬শে সেপ্টেম্বর ওই একই দৈনিক প্রকাশিত আরও একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুন্দরবন-সহ ভারতের অসংখ্য জনমানবহীন ক্ষুদ্র দ্বীপ সম্পর্কে গোয়েন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কারণ ঠিকঠাক ব্যবস্থা না নিলে ওই সমস্ত এলাকার মাধ্যমে বেশ বড়সড় বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে। ওই সমস্ত বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলিকে কিভাবে সুরক্ষিত করা যায়, সে-ব্যাপারে কেন্দ্র, সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকার, নৌ-বাহিনী এবং উপকূলরক্ষী বাহিনী নানা পরিকল্পনা নিয়েছে। এই দ্বীপগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া সুন্দরবনও রয়েছে।
পূর্ব ভারতের সীমা সুরক্ষা নিয়ে এত ঔদাসীন্য কেন?
ঘটনা হচ্ছে, উত্তর-পশ্চিমে যখন পাকিস্তানের সঙ্গে সীমাঞ্চলে প্রবল অশান্তি চলছে, ভারতীয় জওয়ানদের মরতে হচ্ছে চোরাগোপ্তা আক্রমণে, দেশজুড়ে বিক্ষোভের ঝড় উঠেছে, প্রধানমন্ত্রীকে স্বয়ং আসরে নামতে হচ্ছে জনমানসে ক্রোধ সামলানোর জন্যে -- তখন পূর্বদিকের সীমাবর্তী অঞ্চলগুলিতে এত শিথিলতা কেন?
পাকিস্তান এবং চীনকে নিয়ে আমরা যতই জর্জরিত হয় না কেন, আমাদের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলির সীমানাকে কোনওভাবেই হেয় করা চলবে না। বিশেষ করে, বাংলাদেশ সীমান্তকে তো নয়ই। তার বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
মনে রাখা জরুরি যে বাংলাদেশ সীমানার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি, পাকিস্তানের চেয়েও
প্রথমত, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সীমাঞ্চল সবচেয়ে দীর্ঘ। আর যেহেতু বাংলাদেশ দেশটি গরিব কিন্তু তার লোকসংখ্যা প্রচুর, তাই ভারতের স্বাভাবিকভাবেই সচেতন থাকা উচিত সীমা উল্লঙ্ঘনের ব্যাপারে।
দ্বিতীয়ত, ভারত-বাংলাদেশের সীমা আন্তর্জাতিকের থেকেও বেশি স্থানীয়। বিশেষত, পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমাটি আসলে একই সংস্কৃতিকে দু'ভাগ করেছে। সেইরকম সীমাকে পাহারা দেওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয় কারণ মানুষে-মানুষে যোগাযোগ এতই দৃঢ় যে শুধু কাঁটাতারের কার্যকারিতা সেভাবে থাকে না। পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক নানাভাবেই এই অঞ্চলের মানুষ একে ওপরের কাছাকাছি। তাই এই সম্পর্কগুলির ফাঁক গোলে জঙ্গি যদি ঢুকে পড়ে, তবে তাকে আটকানো বেশ কঠিন।
তৃতীয়ত, সীমারক্ষীদের মধ্যে দুর্নীতিমূলক কারবার তো আছেই, পাশাপাশি একজন পশ্চিমবঙ্গের একটি সীমান্তবর্তী গ্রামের আম মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের এক বহিরাগতরা মধ্যে শারীরিক অমিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার উপর সীমাঞ্চলগুলিতে অত্যধিক মানুষের বসবাস এবং ফলস্বরূপ, সীমারক্ষীদের উপর প্রবল চাপের সমস্যা তো আছেই।
অনুপ্রবেশ নিয়ে রাজনৈতিক আকচা-আকচি তো খুব হচ্ছে দেখি, কাজের কাজ কী হচ্ছে?
তাই এমনিই যখন এত সমস্যা, সেখানে এই জঙ্গিহানার যুগে কেন ভারত-বাংলাদেশ সীমা এলাকার প্রতি বিশেষ নজরদারি চালানো হবে না? বাংলাদেশ থেকে অবিরাম অনুপ্রবেশ ঘটছে পশ্চিমবঙ্গ সহ উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যে, তা নিয়ে রাজনৈতিক কলহ তো প্রচুর দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সমস্যার সমাধানে বাস্তবে কতটা কাজ হচ্ছে?
এই বছর অসমে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে বিজেপি জানিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশ সীমান্তে অচিরেই 'সিল' করে দেওয়া হবে। কিন্তু তার আগে, বিজেপি এও জানিয়েছে যে বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু শরণার্থীদের তারা ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করবে। এটা ঠিক কি ধরনের অনুপ্রবেশ নীতি?
যদি 'সেকুলার' দলগুলি বছরের পর বছর সংখ্যালঘু তোষণ করেছে সীমান্তের 'কাঁটাতার হটিয়ে', তবে সংখ্যাগুরু তোষণের মধ্যে দিয়ে বিজেপি কী আলাদা কথা বলছে? সীমান্তনীতি কি তাহলে ধর্ম-কেন্দ্রিক রাজনীতিই ঠিক করবে আজীবন?
খাগড়াগড়ের পরেও আমাদের শিক্ষা হয়নি? অবিশ্বাস্য!
অথচ, এই যে ট্রেন থেকে লোকে যত্রতত্র নেমে বেমালুম হওয়া হয়ে যাচ্ছে বা অসংখ্য দ্বীপের সুরক্ষা ঢিলেঢালা হয়ে পড়ে আছে, সে-দিকে কারও নজর নেই। ২০০৮ সালের মুম্বইএর অতবড় হানার পরেও আমাদের জলপথ সুরক্ষিত নয়; ২০১৪-র খাগড়াগড় কাণ্ডের পরও মৈত্রী এক্সপ্রেসের উপর বিশেষ নজরদারি নেই।
আর কবে বুঝবেন?
ভারতের বিদেশ- এবং প্রতিরক্ষানীতি প্রণয়নকারীরা যদ্দিন না বুঝছেন যে বাংলাদেশের জমি আজ ভারতের নিরাপত্তার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, ততদিন আমার আপনার সবার প্রাণই সরু সুতোয় ঝুলে থাকবে। মমতা-মোদীরা নির্বাচনে জিততেই থাকবেন কারণ রাজ্যে বা কেন্দ্রে তাঁদের বিরোধিতা করার জন্যে কেউই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু এই জয়োল্লাসের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তার কথাটা যদি সবাই বেমালুম ভুলে যান, তবে আগামী দিনগুলি ভয়ঙ্কর।