মুম্বই, পাঠানকোট থেকে উরি: পাকিস্তানকে বিঁধে কী হবে যদি না নিজেদেরই প্রতিরক্ষা শক্তিশালী হয়
উরির সেনা ছাউনিতে ১৮জন জওয়ানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর ভারত-পাক সম্পর্ক যথেষ্ট উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। দু-দেশের নেতৃত্বই আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিনিয়ত দরবার করে চলেছে প্রতিপক্ষকে কোনঠাসা করার জন্যে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের সামনে দাবি উঠেছে নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে গিয়ে পাকিস্তানকে 'উচিত শিক্ষা' দেওয়ার।
কিন্তু উরি কাণ্ডের পর যতটা না বিদেশনীতিতে আলোড়নের ঝড় উঠেছে, তার বিন্দুমাত্রও কিন্তু দেখা যাচ্ছে না প্রতিরক্ষার ব্যাপারে। উরির জঙ্গিহানার পর ভারতীয় গোয়েন্দারা খোঁজ পেলেন আঠেরোই সেপ্টেম্বরের ভোরে হওয়া ওই ঘটনার সময়ে সৈনিকদের নিরাপত্তায় বড় ধরনের ফাঁক ছিল। প্রহরারত সেনাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব বা নিরাপত্তার প্রাথমিক শর্তের লঙ্ঘন - নানা দিকই প্রাথমিক তদন্তের পর উঠে আসছে। কিছু একটা ভুলচুক ছিল কোথাও, মেনে নেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকরও।
নিজেদের প্রতিরক্ষা নিয়ে কতটা ভাবছি আমরা?
পাকিস্তানী জঙ্গি বা সে-দেশের সরকারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদ্গার করে আদৌ কতটা লাভ হবে যদি না আমরা সবার আগে নিজেদের প্রতিরক্ষা জোরদার করি?
ইজরায়েল-এর থেকে শেখার আছে আমাদের
যে পরাক্রমী ইজরায়েলের সামরিক শক্তির আমরা প্রায়শই প্রশংসা করি, তা কিন্তু একপেশে নয়। ইজরায়েলের সামরিক নীতিতে একইরকম গুরুত্ব পায় তার প্রতিরক্ষাও। হামাস বা হেজবুল্লাহ-র বিরুদ্ধে ইজরায়েলের বড় অস্ত্র হচ্ছে তার 'আয়রন ডোম' বা 'লৌহ গম্বুজ' প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যার মাধ্যমে শত্রুর ছোঁড়া প্রায় সমস্ত ক্ষেপণাস্ত্রই লক্ষভ্রষ্ট করে দেয় ইজরায়েলি সেনা। তাই ইজরায়েলের গুণমুগ্ধ হলেও আমরা তাদের বিদেশ/রণনীতির কার্যকারিতা এখনও সম্পূর্ণ শিখে উঠতে পারিনি। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা।
উরনে সন্দেহভাজন সশস্ত্র লোক; যে কেউ ঢুকে পড়ছে এদেশে?
উরিকাণ্ডের রেশ এখনও মেলায়নি, ফের আলোড়ন দেখা দিল মুম্বই-এর কাছে উরনে। সেখানে দু'জন স্কুলছাত্র-ছাত্রী দেখে সন্দেহভাজন কয়েকজন মুখোশধারী, সশস্ত্র লোককে ঘোরাঘুরি করতে। প্রশাসন এরপর নড়েচড়ে বসে। মহারাষ্ট্র সরকার জানায় তারা গত সাতই সেপ্টেম্বর উরনের কাছে যে পরিত্যক্ত নৌকাটি বাজেয়াপ্ত করেছে, সেটার সম্পর্কে এখন পুরোদমে তদন্ত চলছে।
দু'হাজার আটের নভেম্বরে মুম্বই শহরে অতবড় অনিষ্ট হওয়ার পরেও উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে পরিত্যক্ত নৌকা বা ডিঙি পাওয়া যাচ্ছে? তাহলে আমাদের প্রতিরক্ষা আদৌ কতটা জোরদার? আর যদি মুম্বইয়ের মতো মহানগরীর নিরাপত্তারই এই হাল হয়, তবে দেশের যে বিশাল উপকূল পড়ে রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়, সেখানকার খবর কে রাখছে? একই প্রশ্ন তোলা যায় এবছরের গোড়ায় হওয়া পাঠানকোট জঙ্গি হামলা সম্পর্কেও। প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং তাঁর সভাসদরা কি এব্যাপারে কিছু বলবেন?
সেনাদেরকেই সীমানা বানিয়ে ফেলবেন না দয়া করে, তাঁদেরও সুরক্ষা দিন
কাশ্মীরের পাক সীমান্ত এলাকায় প্রায়শই জঙ্গিদের সঙ্গে আমাদের সেনাদের সংঘর্ষ হয় এবং প্রাণ হারান আমাদের জওয়ানরা। কিন্তু সেনাবাহিনী যেমন দেশের সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখার জন্যে আপ্রাণ লড়ছে, তেমনই তাঁদের নিরাপত্তার দিকটাও দেখা উচিত। উরির অরক্ষিত ছাউনিতে যদি তরতাজা সৈনিকদের ঘুমের মধ্যে প্রাণ দিতে হয়, তাহলে সাধারণ দেশবাসীর সুরক্ষা কতটা, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক নয়।
মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে কাশ্মীর সীমান্তে ভারতীয় সৈন্যের মুণ্ডচ্ছেদ করা নিয়ে মনমোহন সরকারকে অনেক কটাক্ষ করেছেন আমরা দেখেছি। পাঠানকোট বা উরি কাণ্ডের পর উনি কি বলবেন?
সমস্যা হচ্ছে, আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক পাশাখেলার বোড়ে বানিয়ে ফেলেছি ক্রমশও। সেনার মৃত্যুতে রাষ্ট্র শোকপ্রকাশ করে, শহীদদের প্রতি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা জ্ঞাপন করে, কিন্তু একইসঙ্গে, সৈন্যদের মৃত্যুমিছিলের ফলে তৈরী হওয়া যে 'সিম্প্যাথি ওয়েভ' তৈরী হয়, তারও পুরো ফায়দা লোটে। কেন আমরা আমাদের একজন সেনারও যাতে প্রাণহানি না হয়, তা নিশ্চিত করব না?
সেনা সীমা পাহারা দেবে ঠিকই, কিন্তু সেনাকেই সীমা বানিয়ে ফেলা মোটেই উচিত কাজ নয়। জওয়ানদের মৃত্যুর ফলে দেশ জুড়ে জাতীয়তাবাদী জিগির যত জবরদস্ত হয়, তত রাষ্ট্রশক্তির পোয়াবারো। আর সঙ্গে তো অত্যুৎসাহী বেসরকারি সংবাদমাধ্যম আছেই। কিন্তু এই রাজনীতিই যদি আসল অভিসন্ধি হয়, তবে আর পাকিস্তানকে "উড়িয়ে দেব, গুঁড়িয়ে দেব" বলে গরম বিবৃতি দেওয়া কেন?
প্রতিরক্ষা যে রণনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়, সেটা নয়াদিল্লি কতটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে জানা নেই, কিন্তু সত্যি যদি এই ক্লান্তিকর এবং রক্তক্ষয়ী লড়াই জিততে হয়, তবে এব্যাপারে আশু মনোনিবেশ করা জরুরি। নইলে সমস্ত বাগাড়ম্বরই সার। আরও অনেক মায়ের কোল আর স্ত্রীর হাত খালি হয়ে যাবে।