এত "সেনা, সেনা" কোলাহল কেন? কই, কৃষক, চিকিৎসক বা শিক্ষকদের নিয়ে তো একটা কথাও শুনি না
সেনাবাহিনী দেশের গণ্ডি রক্ষা করবে, তাতে অত্যাশ্চার্যের কিছু নেই। যাঁর যেটা কাজ সেটা তিনি বা তাঁরা করছেন। কিন্তু এই সাম্প্রতিককালে উঠতে বসতে সেনাবাহিনীর জয়গান শুরু হয়েছে যেভাবে, তাতে বেশ অস্বস্তি বোধ হয়।
দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আম জনতা যেভাবে "জয় জওয়ান" বলে অহরহ মেতেছেন, বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে; যেভাবে বলা হচ্ছে সৈন্যরা না থাকলে আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতাম না, তাতে মনে প্রশ্ন আসে: একটি দেশ চালাতে কি তাহলে সেনাই আসল এবং শেষ কথা?
লালবাহাদুরের "জয় জওয়ান" আজও আছে বহাল তবিয়তে, কিন্তু "জয় কিষান"?
এই প্রসঙ্গে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর "জয় জওয়ান, জয় কিষান" কথা মনে পড়ে। ১৯৬৫ সালে এইরকমই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে তিনি দেশের সীমা সুরক্ষা করতে যেমন জওয়ানকে আহবান জানান, তেমনই দেশের খাদ্য সরবরাহকে সুরক্ষিত করতে কৃষককে উৎসাহিত করেন। ভারতের সমস্ত আর্থ-সামাজিক জীবনযাত্রার এপ্রান্তকে ওপ্রান্তের সঙ্গে এক সুরে বেঁধে ফেলার কাজ ম্যাজিকের মতো করেছিল লালবাহাদুরের ওই স্লোগান। আজও লালবাহাদুরের স্বল্পসময়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের কথা উঠলেই "জয় জওয়ান, জয় কিষান"-এর কথা চলেই আসে অনিবার্যভাবেই।
কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে কি কিষানের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন ভারতের নেতৃত্ব এবং আম জনতা? নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে নির্বাচিত হওয়ার আগেও বিহারের বক্সারে লালবাহাদুরের স্লোগান আউড়েছিলেন। সেনাবাহিনীর সঙ্গে কৃষকদের দূরবস্থার কথাও উঠে এসেছিল তাঁর ভাষণে। কিন্তু আজ তাঁদের কথা আর বিশেষ শোনা যায় না গেরুয়াপন্থীদের গলায়।
কৃষক আত্মহত্যা ঠেকাতে বিজেপি সরকার কী করছে?
অথচ মোদী সরকারের প্রথম বছরেই মহারাষ্ট্রের বিদর্ভে কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা তেরোশো ছাড়িয়ে যায়। রাজ্যের বিজেপি-নেতৃত্ত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। প্রশ্ন ওঠে খোদ মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিস যেখানে বিদর্ভের মানুষ, সেখানে স্থানীয় কৃষকদের প্রতি তাঁর সরকারের এই উদাসীনতা? প্রশ্ন ওঠে চাষিদের প্রতি বিজেপির আকাশছোঁয়া প্রতিশ্রুতি নিয়েও।
সাধারণ মানুষও নির্বিকার
সরকারি স্তর ছাড়াও, সাধারণ মানুষের মধ্যেও কখনও চোখে পড়ে না কৃষকদের সমস্যা নিয়ে কোনও আলোচনা হতে। খবরের কাগজের সম্পাদকীয়তে একটি দু'টি লেখা দেখা যায় বটে বা কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধীকে বিভিন্ন সময়ে 'কিষান সভা' করতে দেখা যায় বটে, কিন্তু সেসবের বিশেষ প্রভাব কিছু নেই। ও করার জন্য, তাই করা -- হয় খবরের কাগজের সাদা পাতা ভরাতে বা নির্বাচনের আগে নিজেদের 'মুখশুদ্ধি' করতে। ব্যতিক্রমী কণ্ঠ বা গোষ্ঠীও অবশ্যই আছে কিন্তু তাঁরা নেহাতই সংখ্যালঘু।
এই আগ্রাসী মধ্যবিত্তের 'আমিত্ব'
আশঙ্কা হয় যখন সাধারণ মানুষকেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের তালে তাল ঠুকতে দেখি। এ-দেশে মধ্যবিত্ত বলে যে প্রকাণ্ড প্রাণীটি, সে অত্যন্ত স্বার্থপর জানা কথা, কিন্তু তার কি মগজেও জং ধরেছে যে সমস্ত সুস্থ ভারসাম্যের চিন্তাভাবনা লোপ পেতে বসেছে? মধ্যবিত্ত নিজেকে সুরক্ষিত মনে করে উদার অর্থনীতি, দেদার ভোগবাদী সুযোগ, পুঁজিমুখী গণতন্ত্র, সংখ্যাগুরুর সর্বব্যাপী পরিচয়, শোরগোলসর্বস্ব মিডিয়া, শক্তিশালী সেনা, পরমাণু বোমা এবং এইসব মিলিয়ে এক অতিজাতীয়তাবাদী জিগিরের ঘেরাটোপে।
প্রবল আমিত্বের এই কড়া মানসিকতায় 'ওরা' বা 'ওদের' বিশেষ জায়গা নেই -- তা সে দেশের মধ্যে সংখ্যালঘু বা কৃষকরা হোক বা দেশের বাইরে পাকিস্তান বা সে-দেশের মদতপুষ্ট জঙ্গি। এই যে 'এক্সক্লুসিভিস্ট' মানসিকতা আজ আমাদের মধ্যে, তা গেরুয়াপন্থী রাজনৈতিকদের অনেক দিক থেকেই সুবিধে করে দিয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে নেহরুবাদী গণতন্ত্রের পরিচয়। বোঝানো হচ্ছে যে নেহেরু আদতে ভীতু ছিলেন, এখন মোদীর ছাপ্পান্ন ইঞ্চির ছাতি দ্যাখো। ওকেই বলেই জাতীয়তাবাদ।
শুধু অস্ত্রসুরক্ষাই সুরক্ষা? খাদ্য বা স্বাস্থ্য বা শিক্ষাসুরক্ষা কিছু নয়?
অথচ এই অবিরাম "সেনা, সেনা" করে যে কোলাহল চলছে, এতে শুধু দেশের অন্যান্য সমান গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়ের মানুষদের (যেমন কৃষক, যাঁরা আমাদের খাদ্যসুরক্ষা দেয় আর যেটা না থাকলে সেনা বাহিনীর বন্দুক ঘুরে তাকাবে দেশের মধ্যেই) উপেক্ষা করা তো হচ্ছেই, পাশাপাশি সেনাকেও আসলে ব্যবহার করা হচ্ছে মানুষের আবেগকে ক্রমাগত তাতাতে। করছে দেশের চালকরা, কর্পোরেট মিডিয়া -- যাঁদের আসল লক্ষ্য মুনাফা, রাজনৈতিক হোক বা অর্থনৈতিক। আর উপভোক্তার ন্যায় আম জনতা কোনও চিন্তাভাবনা না করে তাতেই গা ভাসাচ্ছে। চিন্তাভাবনা নেই এ'দেশের চিকিৎসক বা শিক্ষকরা বা উল্টোদিকে, রোগীরা বা শিক্ষার্থীরা কেমন আছেন তার সম্পর্কেও।
নির্বাচনের আগে নেতারা সজাগ হন, জওয়ানরা সবসময়ই সজাগ থাকেন; তাই ওদেরকে ছোট করবেন না
উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের কয়েকমাস আগে সেনার সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে গদগদ হয়ে অনেক গেরুয়া নেতাকেই মোদী সরকারকে বাহবা দিতে দেখা যাচ্ছে। এই মনোভাব আসলে সেনার কৃতিত্বকেই খাটো করে কারণ সেনা সরকার নির্বিশেষে নিজেদের বীরত্ব ফলায় না। যদি এদেশের সাধারণ মানুষ 'সেনা জেগে আছে বলে' শান্তিতে ঘুমোয় আজকে, তাঁরা তা মোদী ক্ষমতায় আসার অনেক আগেও করত। তাই এই পুরো ব্যাপারটার মধ্যে আছে সেনাকে বোড়ে করে রাজনৈতিক নেতাদের নিজেদের সমর্থনের জায়গাটাকে আরও একবার ঝালিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা। আর আমরা সেটা বুঝেও বুঝি না। কই, এই সেনা অধিকারিকরাই যখন অবসর নিয়ে 'One Rank One Pension'-এর দাবি তুলে দিনের পর দিন বিক্ষোভ করেন, তখন তো রাজনৈতিক নেতাদের টনক নড়তে দেখি না।
অতিজাতীয়তাবাদী মিডিয়াও সমানে মানুষের আবেগ বিক্রি করে চলেছে মুনাফা লোটার দায়ে
মিডিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। প্রতিদিন রাত্রেই বেশ কিছু মিডিয়া চ্যানেল নিজেদের ক্যাঙ্গারু করতে বসিয়ে দেয় টিভিতে। যেন দেশের তামাম রীতিনীতি তারা ওই কয়েকঘন্টার মধ্যেই ঠিক করে ফেলবে। উগ্র জাতীয়তাবাদের কাঁসর-ঘন্টা বাজতে শুরু করে। নিয়ে আসা হয় অবসরপ্রাপ্ত সেনা আধিকারিকদের।
তাঁরাও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন (সেটা স্বাভাবিক, কারণ তাঁরা তাঁদের নিষ্ঠার জায়গা থেকে কথা বলেন) আর সেই আবেগকে ভাঙিয়ে বাজার ধরার চেষ্টা করে কতিপয় কিছু মুখোশধারী দেশপ্রেমিক। এই একই কণ্ঠস্বর কিন্তু কৃষকদের সমর্থনে শোনা যায় না। শোনা যাবে কেন? কৃষকদের তো আর 'জাতীয়তাবাদী' খেলার বোড়ে বানানো যায় না।