ভাবমূর্তি কলূষিত, মানুষের মন থেকে হারিয়ে যেতে বসা তারকা-সাংসদ তাপস পালের হাতিয়ার ছিল কাজ
সবসময়ই যেন বিতর্ক তাড়া করে কৃষ্ণনগরের তারকা সাংসদ তাপস পাল। তৃণমূলের হয়ে রাজনীতির ময়দানে কেমন কাজ করছেন তিনি? কি বলছেন বিরোধীরা? একনজরে দেখে নিন এই প্রতিবেদনে।
তাপস পাল নামটা মনে এলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে দাদার কীর্তির সরল-সাদাসিধে কেদারের মুখটা। মনে পড়ে যায় ফুটবল পাগল সাহেবের কথা, যিনি অবলীলায় বোনের বিয়ের জন্য নিজের শরীরের একটি কিডনি বিক্রি করে দিতেও দু'বার ভাবেননি। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপঞ্জি তাঁর ভাবমূর্তিতে হয়তো কালিমালিপ্ত করেছে, কিন্তু সেই ভাবমূর্তি পুনরায় ফেরাতে তিনি কাজকেই হাতিয়ার করেছেন। সাধারণ মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে তিনি বদ্ধপরিকর। সেই লক্ষ্যেই সমাজসেবায় ব্রতী সাংসদ তাপস পাল।
সারদা-কাণ্ডের পর তাঁর দলবিরোধী কিছু মন্তব্য ও নিজের সংসদ এলাকায় গিয়ে অযথা কিছু অমূলক বাক্য-ব্যয় তাঁর ভাবমূর্তি কলুষিত করেছে। ফলে দল তাঁর সঙ্গে এখনও দূরত্ব বজায় রেখেই চলছে। তারপর শারীরিক অসুস্থতা তাঁর এলাকা উন্নয়নের ধারায় বার বার বাধ সেধেছে। তবু দ্বিতীয়বার কৃষ্ণনগর থেকে সাংসদ হওয়া তাঁর আটকায়নি। আবারও তিনি সবকিছু ভুলে সমস্ত বিতর্ককে পিছনে ফেলে সমাজসেবায় ব্রতী হয়েছেন।
কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ, পর পর দু'টি টার্ম সাংসদ থেকেও আদতে এলাকার কোনও উন্নয়ন ঘটাতে পারেননি। এলাকার উন্নয়ন নিয়ে সে অর্থে কোনও পরিকল্পনাই নেই তৃণমূলের তারকা-সাংসদের। ফলে পরিবর্তনের জোয়ার লাগেনি কৃষ্ণনগরে।
সাংসদ হওয়ার পর কী কাজ করেছেন, কী করতে চান তাপস পাল?
- নদিয়ার ঐতিহ্যবাহী কৃষ্ণনগর সংসদ এলাকায় প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাইট বসানো হয়েছে। এই ভেপার ল্যাম্প বসানো হয়েছে সাংসদ তহবিলের টাকায়। সাংসদ উপহার দিয়েছেন আলো ঝলমলে কৃষ্ণনগর।
- সাংসদ তাপস পালের প্রতিশ্রুতিই ছিল উন্নত ড্রেনেজ ও নিকাশি ব্যবস্থা, যা স্থায়ী সুরাহা দেবে শহরবাসীকে। তা নিরূপণ হয়েছে। ৫নং ওয়ার্ডের সঙ্গীতা সিনেমা হলের সামনের বিস্তীর্ণ ড্রেন নির্মাণ, জলঙ্গি ও অঞ্জনা খাল সংস্কার সাংসদ কোটায় হয়েছে বলে শাসক দলের দাবি। পোস্টঅফিস মোড়, ধোপা পাড়া, চ্যালেঞ্জের মোড়, সন্ধ্যা মাঠ পাড়া, তাঁতিপাড়া, রাধানগর, ঘোষপাড়া প্রভৃতি এলাকা একটু বৃষ্টি হলেই জলের তলায় ডুবে থাকত। সেই সমস্যার অনেক সমাধান হয়েছে বর্তমানে।
- মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নামেই এই শহর। কৃষ্ণনগরের ঐতিহাসিক গুরুত্বসমন্বিত রাজবাড়ি সংস্কারের পরিকল্পনা রয়েছে সাংসদের।ঘূর্ণী এলাকার বসবাসকারী হতদরিদ্র মৃৎশিল্পীদের পাশে দাঁড়াতে চান সাংসদ। ভাবনায় সমবায়, প্রদর্শনী ও স্থায়ী বিক্রির ব্যবস্থা করা।
- সাংসদ এলাকা উন্নয়ন তহবিলের অর্থে কেনা হয়েছে ১১টি অ্যাম্বুলেন্স। ইতিমধ্যে তা বিতরণও করা হয়ে গিয়েছে। সাংসদ সেই অ্যাম্বুলেন্সের অপব্যবহার নিয়ে ইতিমধ্যে সরব হন। তাঁর অভিযোগ, অনেক অ্যাম্বুলেন্স অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেক অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে ব্যবসা করা হচ্ছে।
- প্রতিবন্ধীদের ব্যবহারের জন্য একটি বাস দিয়েছিলেন এক সংস্থাকে। সেই বাসও বর্তমানে অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন সাংসদ। অভিযোগ, বাসটি একটি নার্সিংহোমের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও জেলা প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান ডাঃ বাসুদেব মণ্ডল এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। কৃষ্ণনগরে চার্চ রোডে নদিয়া জেলা প্রতিবন্ধী কল্যাণ সমিতির ভবনে একটি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় চলে। প্রতিবন্ধীদের সুবিধার জন্যেই সাংসদ তাপস পালকে অনুরোধ করা হয়েছিল একটি বাসের জন্য। সেইমতো সাংসদ ২০১৩ সালে একটি ১৩ আসনের ছোট বাস কেনার জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন সাংসদ কোটায়। গত তিন বছরে বাসটিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আনার কাজই শুধু হয়েছে। নার্সিংহোমের কাজে লাগেনি বাস।
- নদিয়া জেলা হাসপাতালে চক্ষু বিভাগে ফেকো সার্জারির যন্ত্র দেওয়া হয়েছে সাংসদ তহবিলের টাকায়। সম্প্রতি তা উদ্বোধন করেন স্বয়ং তাপস পাল। নতুন ফেকো সার্জারি মেশিনটি বসাতে খরচ হয়েছে ২৫ লক্ষ টাকা।
- জেলা হাসপাতালে তৈরি করা হয়েছে অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটারও। ১৮ লক্ষ টাকা তাপস পালের সাংসদ তহবিল থেকে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এই হাসপাতালের উন্নয়নে আরও সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন সাংসদ। তিনি হাসপাতালের এমনই রূপ দিতে চান, যাতে রোগীদের আর কলকাতায় চিকিৎসার জন্যে যেতে না হয়।
- দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মভিটেতে একটা প্রেক্ষাগৃহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সাংসদ। সেই কাজ শীঘ্র শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।
- এলাকার বিধায়কদের সঙ্গে সমন্বয়ে এলাকা উন্নয়নের জন্য একটি কমিটিও গঠন করেন তিনি।
- এলাকার রাস্তাসংস্কার ও রাস্তা আলোকিত করণেও তিনি তাঁর সাংসদ তহবিল থেকে টাকা বরাদ্দ করেন।
- স্কুল-কলেজের উন্নয়নে সাংসদ তহবিলের টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কম্পিউটার দেওয়া হয়েছে স্কুল-কলেজ ও গ্রন্থাগারগুলিতে।
কোথায় খামতি রয়েছে?
- উড়ালপুলগুলি সংস্কারের কোনও পরিকল্পনা নেই। রেল ওভারব্রিজগুলি ভেঙে পড়েছে। জীর্ণাবস্থা। যেকোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সাংসদ জানেনই না। উদ্যোগ নেই সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের।
- ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক সংস্কারেও উদ্যোগী নন সাংসদ। যাত্রীরা নিত্য সমস্যায় পড়ছেন। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। সাড়ে সাত বছরেরও বেশি সাংসদ রয়েছেন। তবু একটিবারের জন্যও তারকা-সাংসদ সচেষ্ট হননি জাতীয় সড়কের সংস্কারের ব্যাপারে।
- রেলমন্ত্রী থাকাকালীন কৃষ্ণনগর থেকে করিমপুর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের কথা ঘোষণা করেছিলেন রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই কাজ এত বছরেও এতটুকু এগোয়নি। নিজের দলের তারকা প্রার্থীই পর পর দু'বার কৃষ্ণনগরে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। তা সত্ত্বেও এই কাজ শুরু না হওয়ায় সাংসদের ব্যর্থতাই প্রকট হয়।গঙ্গাভাঙন রোখার ব্যাপারে এখনও পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। একটি কথাও এই গঙ্গা ভাঙন নিয়ে খরচ করেননি সাংসদ।
- এছাড়া পলাশিপাড়া থেকে শুরু করে একাধিক ব্রিজের অবস্থাও খারাপ। সেগুলি নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই।
- এলাকা উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা সাংসদের নেই বলে অভিযোগ বিরোধীদের।
- ইদানিং সাংসদের অনুপস্থিতি একটা বড় সমস্যা এলাকা উন্নয়নে। এলাকায় নানা কটূ মন্তব্য তাঁর ভাবমূর্তিকে কলূষিত করেছে। তাঁর গ্রহণযোগত্যা এই মুহূর্তে তলানিতে।কোনও ইন্ডাস্ট্রিয়াল হাব, বড় হাসপাতাল, ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার ভাবনা নেই। পর্যটন শিল্পেও উন্নয়ন ঘটাতে ভাবনার অভাব রয়েছে।
- এলাকা আমূল বদলে যাবে এমন কোনও প্রকল্প আনার ব্যাপারে কোনওদিন সংসদে সরব হননি তারকা সাংসদ।এলাকার উন্নয়ন বা সাধারণের কোনও দাবি নিয়েও সংসদে মুখ খুলতে দেখা যায়নি তাঁকে।
- মানুষ তাঁদের প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছিল সংসদে, তিনি মানুষের আস্থার মর্যাদা রাখতে পারেননি।
কী বলছেন বিরোধীরা?
তারকা সাংসদ চাই না। আমরা চাই কাজের মানুষ। এলাকার মানুষ এখন থেকেই এই দাবিতে সরব। সিপিএম জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেন, মানুষ দ্বিতীয়বার তাঁকে সুযোগ দিয়েছিলেন। তারপরও তিনি আস্থা হারিয়েছেন। তিনি কেবলই একজন তারকা প্রার্থী। কিন্তু তারকা প্রার্থী হয়ে যে এলাকায় প্রভূত উন্নতি ঘটাতে পারতেন, তা থেকে এখনও বঞ্চিত এলাকার মানুষ। একজন সাংসদ হিসেবে যা করণীয়, সেই কাজে চূড়ান্ত ব্যর্থ তিনি। তারপর এখন তো ডুমুরের ফুল হয়ে গিয়েছেন। এলাকায় আর মুখ দেখাতে পারছেন না। এলেও পার্টি অফিস কিংবা অনুষ্ঠান মঞ্চেই সীমাবদ্ধ থাকছেন তিনি।
সুমিতবাবু আরও বলেন, আমরা দলের কেউ সাংসদ থাকলে, তাঁকে দলের তরফ থেকে আমরা পরামর্শ দিতাম, কৃষ্ণনগরের সবথেকে জ্বলন্ত সমস্যা এখন ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক, রেলওয়ে ফ্লাইওভার ও করিমপুর পর্যন্ত রেল লাইন, সেগুলি অনুমোদনের ব্যবস্থা করতে। সেইসঙ্গে এলাকার প্রভূত উন্নয়নে কেন্দ্র সরকারের কাছ থেকে প্রকল্প ছিনিয়ে আনাই হত সাংসদের মূল লক্ষ্য। কারণ একজন সাংসদ তো আর পুরসভা, জেলা পরিষদের কাজগুলি করবেন না। তাঁকে ভাবনা হবে আর সুদূরপ্রসারী। সেইরকম কোনও ভাবনার বহিঃপ্রকাশ আজ পর্যন্ত হয়নি। তাপসবাবু তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। তাই দ্রুত আস্থা হারাচ্ছেন মানুষের।
কী বলছেন সাংসদ?
প্রথমে আমি একজন ফিল্ম স্টার। তারপর সমাজসেবী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় মানুষের পাশে থেকে মানুষের জন্য কাজ করাই জীবনের ব্রত করেছি। এলাকা উন্নয়নের কাজই একমাত্র লক্ষ্য। অভিনয় জীবনের পরে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োগ করতে চেয়েছিলাম। সেই লক্ষ্যেই প্রথমে বিধায়ক, পরে সাংসদ হয়েছি। কৃষ্ণনগরের মানুষের পাশে থাকাই আমার এক ও একমাত্র লক্ষ্য এখন। কৃষ্ণনগরকে উন্নয়নে মুড়ে দিতে চাই।
গত টার্মে সাংসদ কোটার সমস্ত টাকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ করেছি। এবারও চেষ্টা করছি সাংসদ কোটার ওই স্বল্প টাকায় মানুষের জন্য যথাসাধ্য করার। আরও অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের স্মৃতি রক্ষার্থে রাজবাড়ির সংরক্ষণ, দিজেন্দ্রলাল রায়ের বাড়ির সংরক্ষণ, সবই ভাবনায় রয়েছে। এলাকার মানুষ আমাকে সুযোগ দিয়েছেন আবার, আমি তাঁদের নিরাশ করব না।