হাওড়া রায় বাড়ির পুজো : খড়্গের এক কোপে ‘বলি’ হয়েছিল ‘মায়ের বাহন’, সেই থেকেই বন্ধ বলিদান
নবমীর দিন বলিদানের সময় বয়ে যায়। দেখা নেই কর্মকারের। জঙ্গলের পথ দিয়ে রায় বাড়িতে আসতে গিয়েই বাঘ-বন্দি হয়ে পড়েছিলেন কর্মকার। শেষপর্যন্ত এক খড়্গের কোপে বাঘ 'বলি' করে তবেই পৌঁছেছিলেন জমিদারবাড়ির পুজো মণ্ডপে। সেবারই শেষবারের মতো হয়েছিল বলিদান। মায়ের স্বপ্নাদেশ হয়েছিল, 'বলি হয়েছে আমার বাহনই। তাই এবার বন্ধ হোক বলিদান।
সেই থেকে হাওড়ার জয়পুরের রায় পরিবারের পুজোয় চিরাচরিত বন্ধ বলিদান প্রথা। আজও ঐতিহ্য বজায় রেখে ২৯২ বছরের সুপ্রাচীন পুজোয় প্রতিপদাদি কল্পারম্ভ হয়। পুজো হয় জমিদার বাড়ির নিয়ম মেনেই। আড়ম্বর কমেছে, কিন্তু সবই আছে আগের মতোই। শুধু মায়ের স্বপ্নাদেশে বন্ধ হয়েছে বলিদান।
সে প্রায় ১৮০ বছর আগেকার কথা। জয়পুরের আমরাগোড়িতে রায় পরিবারের পুজোয় বলিদানের জন্য জঙ্গলের সোজা রাস্তায় আসছিলেন জনৈক কর্মকার। হন্তদন্ত হয়ে আসার সময়ই ঘন জঙ্গলের মধ্যে তাঁর পথ আটকে সামনে দাঁড়িয়ে পেল্লায় এক বাঘ। দেখেই থরহরি কম্পমান কর্মকার একছুটে উঠে পড়েছিলেন গাছে। গাছের মগডালে কেটে গিয়েছে দীর্ঘক্ষণ। বাঘটি ঠায় দাঁড়িয়ে গাছের তলায়। পুজো বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গিয়েছে। বলিদানের সময় আসন্ন। এখনও কর্মকার এসে পৌঁছননি। সময় যে বয়ে যাবে বলিদানের। সেই কর্মকারও গাছের মগডালে বসে সুস্থির নেই।
সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মনের জোরে 'জয় দুর্গা' বলে খড়্গ নিয়ে লাফিয়ে পড়েছিলেন বাঘের উপর। খড়্গের এক কোপে মুণ্ডচ্ছেদ করে দিয়েছিলেন সেই বাঘের। তারপর মায়ের স্বপ্নাদেশ, ''বলিদান করতে যাওয়ার পথে আমার বাহনকেই বলি দিয়েছে কর্মকার। তাই এবার থেকে বন্ধ হোক বলিদান।'' সেই থেকেই বন্ধ হয়ে যায় বলিদান। আজও চলছে সেই রীতি।
ওই পরিবারের বর্তমান বংশধর সৌরভ রায় ও প্রবীণ সদস্য রোহিণীমোহন রায়ের মুখেই শোনা সেই ১৮০ বছর আগেকার 'গল্পকথা'। বাংলার ১১২৬ সালে রায় পরিবারের তৎকালীন বংশধর শান্তিরাম রায় প্রতিষ্ঠা করেন প্রায় তিনশতাধিক বছরের প্রাচীন এই পুজোর। তখন জয়পুরের এই এলাকায় ছিল না কোনও বসতি। জঙ্গলে পরিপূর্ণ পুরো এলাকা। নৌকা ভিড়ল আমরাগোড়িতে। গড়ে উঠল বসতি। তৈরি হল গ্রাম। দেবীর স্বপ্নাদেশে শুরু হল দুর্গা আরাধনা।
বর্তমানে গজলক্ষ্মী মাতা স্টেটের নামে চলেছে এই পুজোর আয়োজন। শুরুর দিন থেকেই প্রতিপদাদি কল্পারম্ভ হয়ে আসছে. আজও তার অন্যথা হয় না। এই পুজোর আর এক রীতি, ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিসর্জন হয় দুপুর ১২টার পর। বাড়ির এক সদস্যের মৃত্যু হয় বিজয়ার দিন। সেবার বিসর্জন দেওয়া হয়েছিল দুপুর ১২টায়।
সেই থেকেই এই রেওয়াজ চলে আসছে। স্টেটের সভাপতি ও সম্পাদকের কথায়, এবারও মহালয়ায় পিতৃপক্ষ অবসানের পর দেবীপক্ষের সূচনা সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যাবে ধূমধাম করে পুজো। দশদিনভর নানা আনন্দ অনুষ্ঠানে জমজমাট হয়ে উঠবে অমরাগোড়ির রায়বাড়ির।