বাঙালির অনন্ত উৎসব: আসছে বছর যদি না হয়, তখন?
ঠাকুর বিসর্জনও যায়নি, চতুর্দিক দেখি "আসছে বছর আবার হবে" পোস্টে ছয়লাপ। অর্থাৎ, মায়ের পরবর্তী আগমনের (সামনের বছর নাকি সেপ্টেম্বর মাসেই পুজো, তার মানে আর ৩৬৫ দিনও বাকি নেই) জন্যে আমরা উদগ্রীব। মাঝের কয়েকটা মাস অনন্ত উৎসব, রাজনীতি, সমালোচনা করেই কেটে যাবে। এই প্রবণতা কিন্তু অন্য কোনও প্রদেশের উৎসবে দেখা যায় না। একটানা এতদিনের উৎসবও বা আর কোথায় দেখা যায়?
এর মধ্যে দিয়ে কি তবে বাঙালির কাজে ফাঁকি দিয়ে শুধুই আনন্দ করে বেড়ানোর সহজাত প্রবৃত্তি প্ৰকাশ পায়? আশ্বিন মাস পড়লেই বাঙালির মন উড়ুউড়ু করতে শুরু করে। আপিসেও লম্বা ছুটি দিয়ে দেন জনগণের নেত্রী। শারদ প্রাতে আর যেন সবুর সয় না দফতরে তালা ঝোলাতে।
কিনতু
এই
কাজের
সঙ্গে
উৎসবের
ভারসাম্য
বজায়
রাখতে
না
পারার
বঙ্গজ
রীতির
কারণটা
ঠিক
কী?
একথা
ঠিক
যে
পুজোর
পরেও
প্রতিমা
ভাসানের
কথা
মনে
না
আনার
প্রবণতা
এখন
অনেকটাই
কমেছে,
নিরঞ্জন
প্রক্রিয়া
এখন
অনেক
শৃঙ্খলাবদ্ধ।
কিনতু
সে
তো
আইনের
লালচক্ষুর
ভয়ে
।
সুযোগ
পেলে
বাঙালি
যে
পুজোর
আনন্দময়
দিনগুলি
এক
ধাক্কায়
অনেকটাই
বাড়িয়ে
নেবে
তা
বোঝা
দুষ্কর
নয়
।
লেজ
লম্বা
করতে
না
পারলেও
বাঙালি
তো
দুর্গাপুজোর
মাথা
সামনের
দিকে
টেনে
এখন
মোটামুটি
মহালয়া
থেকেই
আয়োজন
শুরু
করে
দিচ্ছে।
পাশাপাশি,
গণেশ
পূজার
মতো
অন্যান্য
পার্বণের
আমদানিও
ঘটেছে
ভালো
রকম।
যিশুখ্রিস্টের
জন্মদিন,
মহাবীরের
আবির্ভাব
দিবস
--
সবেতেই
আছে
বাঙালি
পা
বাড়িয়ে।
এর একটি কারণ ইতিহাসে রয়েছে
এই প্রবণতার দু'টি প্রধান কারণ। প্রথমটি ইতিহাসগত। এদেশে আগমনের পর ব্রিটিশরা তৈরি করতে চেয়েছিল এক করণিক শ্রেণী কারণ তাতে প্রশাসনিক কাজে খরচ কমবে। বাঙালি যেহেতু পড়াশোনা করত, তাই তাকে প্রশাসনিক চরকায় তেল লাগানোর কাজে আরও ভালোভাবে সাফল্য পেল ঔপনিবেশিকরা।
অবশ্য, তার প্রধান কৃতিত্ব প্রাপ্য সিরাজ-উদ-দৌল্লা সাহেবেরও। পলাশীর যুদ্ধে তিনি যদি না হারতেন তাহলে বাঙালির এই রাতারাতি কেরানি তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়াটা একটু বিলম্বিত হত আর কী। আর কেরানি হওয়ার ফলে বাঙালি শিখল কী করে একঘেয়ে কলম পেশার কাজকে ভালোবাসতে না পারা যায় । এই কাজে যেমন কোনও পুরস্কার নেই, তেমন নেই ফাঁকি মারার শাস্তিও কারণ প্রশাসন নামক বিশালবপু প্রাণীটিকে সরকার এমনিই চালায়। তাতে কর্মীদের ট্যালেন্টের প্রয়োজন পড়ে না।
আর তাই ওই কী করলাম না করলাম তা নিয়ে বাঙালির কোনও পাপবোধ নেই। এবং শতাব্দীর পর শতাব্দীর পর এই রীতি চলার পর আজ আর 'রাষ্ট্রের ভৃত্য' বাঙালি কাউকেই ডরায় না । ব্রিটিশ থেকে শুরু করে আজকের তৃণমূল শাসকরাও এই স্বভাবকে আর বদলের কথা ভাবেনি। সামাজিক ব্যাধিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর দুঃসাহস আর কোন বুদ্ধিমান প্রশাসন করে?
আর দ্বিতীয়টি রয়েছে বর্তমানেই
দ্বিতীয় কারণটি বর্তমান এবং অর্থনৈতিক । বাঙালি ভদ্রলোক যেমন করণিকের ভূমিকা পালন করেই জীবন অতিবাহিত করে দিলেন, চৌত্রিশ বছরে কতটা এগোলেন না পিছোলেন, সে নিয়ে আর ভাবনাচিন্তা করার সময়ই পেলেন না; তেমনই এখনকার বঙ্গদেশের বাঙালি প্রজন্ম আগামী দিনে কী পরিস্থিতি আসতে চলেছে, সেসব নিয়ে ভাবতে উৎসাহী নয়। আজকের মতো আনন্দে থাকলেই যথেষ্ট আর এই অনন্ত আনন্দ দেওয়ার মতো উপলক্ষ দুর্গাপুজো ছাড়া আর কী বা আছে? তাই আসছে বছর আবার হবে!
আর তাতে শাসকদেরও পোয়াবারো
যত জনতা পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকে আফিমে বুঁদ হয়ে থাকার মতো, ততই তো প্রশ্ন কম উঠবে নেতাদের কাছে। "চাকরি কোথায়? কারখানা কোথায়?" এসব বড় গা-জ্বালানি প্রশ্ন। তার চেয়ে পুজো করুন না। আমরাও করছি, হাত মেলান আমাদের সাথেও। ওনাদের তো আর পূর্বতন শাসকদের মতো 'নিরীশ্বরবাদ'-এর বোঝা বইবার দায় নেই ।
এই পুরোনো 'কলমবাজ' ভদ্রলোক বাঙালি আর নতুন প্রজন্মের 'হুজুগবাজ' বাঙালি ছাড়া অবশ্য একটি তৃতীয় শ্রেণীর বাঙালিও আছে। তাঁরা হলেন এনআরআই বা এনআরবি বাঙালি। বিশ্বায়িত দুনিয়াতে খেটে খাওয়া এই শ্রেণীর বাঙালিরা অবশ্য উৎসব এবং দৈনন্দিন জীবনে ভারসাম্য বজায় রাখার ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে।
কারণ, তাঁদের জীবন বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে একাঙ্গ, বঙ্গদেশের প্রাগৈতিহাসিক বা বিচ্ছিন্ন বাঙালির মতো মর্জির নবাব হওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাঁদের ফেসবুক দেওয়ালে 'সামনের বছর পুজোয় কলকাতা যাব' লেখা দেখলে বোঝা যায় যে এবারের উৎসবে যোগ না দেওয়ার যন্ত্রণা থাকলেও তাঁরা তা জীবনের অঙ্গ হিসেবে নিতে শিখে গিয়েছেন। কিনতু 'আসছে বছর আবার হবে'-র মধ্যে যেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি উদাসীনতার বার্তা রয়েছে।
বঙ্গদেশের বাঙালির এই স্লোগান বেশ বিপজ্জনক লাগে শুনতে আজকাল। যদি সামনের বছর পুজো না হওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয় রাজ্যে?